ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা
ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা

ইসরায়েলি হামলায় নিহত ১৮ হাজার ফিলিস্তিনিকে দাফন করেছেন বৃদ্ধ গোরখোদক হাতাব

গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার ও নৃশংস হামলায় নিহত প্রায় ১৮ হাজার মরদেহ দাফন করেছেন ৬৫ বছর বয়সী গোরখোদক ইউসেফ আবু হাতাব। আর এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে রইলেন তিনি। বার্তা সংস্থা আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে হাতাবের খবর খননের বিষয়টি উঠে এসেছে।

দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসের কবরস্থান পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ফাটা হাতে কোদাল নিয়ে একের পর এক মরদেহ দাফন করেছেন তিনি। এই কবরগুলোর অধিকাংশ মরদেহের কোনো নাম–পরিচয় ছিল না। কারণ, ইসরায়েলেরর নির্বিচার বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীরের দেহাবশেষ কেবল এসব কবরে রাখা হয়েছিল।

আনাদোলুকে আবু হাতাব বলেন, ‘অকল্পনীয় চাপের মুখে এবং বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হওয়ায় আমরা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে গণকবর, ব্যক্তিগত কবর এবং হাসপাতালের ভেতরে মরদেহ দাফন করেছি।’

হাতাব জানান, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে একবার তাঁকে একটি গর্তেই ১৫টি মরদেহ দাফন করতে হয়েছিল।

২০০৫ সালে শুরু হওয়া হাতাবের কর্মজীবনে এবারের ইসরায়েলি হামলাই ছিল সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়। তিনি বলেন, ‘পুরো যুদ্ধজুড়ে আমি ১৭ হাজার থেকে ১৮ হাজার ফিলিস্তিনির দাফন কাজ পরিচালনা করেছি।’

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই নৃশংস যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রায় ৭১ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৭১ হাজারের বেশি মানুষ।

গত ১০ অক্টোবর ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তেব ইসরায়েল চুক্তি লঙ্ঘন করে বারবার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি।

গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্যমতে, যুদ্ধবিরতির পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪০৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

গণকবর ও লাশের স্তূপ

আবু হাতাব প্রতিদিন ভোর ৬টায় কাজ শুরু করেন এবং কখনো কখনো সূর্যাস্তের পরও কাজ চালিয়ে যান। সরঞ্জাম ও উপকরণের অভাবে তিনি ধ্বংসস্তূপ থেকে কুড়িয়ে আনা পাথর ও টাইলস ব্যবহার করে কবর মেরামত করেন এবং মৃতদের সম্মান জানানোর চেষ্টা করেন।

হাতাব আক্ষেপ করে বলেন, ‘পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে কবর তৈরির সামগ্রী, কাফন বা প্রয়োজনীয় কোনো সরঞ্জাম নেই।’

হাতাব বলেন, যুদ্ধবিরতির পর দাফনের সংখ্যা আগের তুলনায় কমলেও প্রতিদিন এখনো বেশ কিছু মরদেহ আসছে। যুদ্ধের শুরুর দিকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টি করে মরদেহ দাফন করতে হতো। গত বছর খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলি অবরোধের সময় তিনি একাই সেখানে প্রায় ৫৫০টি মরদেহ দাফন করেছিলেন।

ইসরায়েলি হামলার কারণে গাজাবাসী পাড়ামহল্লা, উঠান, বিয়ের হল এবং খেলার মাঠে অস্থায়ী কবর তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে।

গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৬০টি কবরস্থানের মধ্যে ৪০টিই ইসরায়েলি বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ১ হাজারের বেশি মরদেহ চুরি করেছে। এ ছাড়া হাসপাতালের গণকবর থেকে ৫২৯টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো ১০ হাজার বেশি মরদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।

কান্নার শব্দ ও দুঃসহ স্মৃতি

কর্মীর অভাব ও সম্পদের স্বল্পতার কারণে আবু হাতাব একাই মৃতদেহ ধোয়ানো, কাফন পরানো, দাফন এবং দাফনের তথ্য নথিবদ্ধ করার কাজ করছেন। তিনি সবকিছু নিজের মুঠোফোনে রেকর্ড করে রেখেছেন।

আবু হাতাব বলেন, কখনো কখনো পাথর বা সিমেন্ট না থাকায় শুধু ব্যাগ দিয়েই মরদেহ দাফন করতে হয়েছে। ১৯৮৮ সালে এবং এবার ইসরায়েলি হামলায় তিনি নিজেও আহত হয়েছেন।

সবচেয়ে হৃদয়বিদারক মুহূর্তগুলোর কথা স্মরণ করে এই ফিলিস্তিনি গোরখোদক বলেন, একবার তিনি একজন বাক্‌প্রতিবন্ধী নারী ও তাঁর চার সন্তানকে দাফন করেছিলেন। এর দুই মাস পর কিছু অজ্ঞাত দেহাবশেষ পাওয়া গেলে তিনি সেগুলোও একই স্থানে দাফন করেন। এ ছাড়া রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, যা প্রাণীরা খুবলে খাচ্ছিল, সেগুলোও তাঁকে দাফন করতে হয়েছে।

এই ভয়াবহ দৃশ্যগুলো দেখার পর হাতাব রাতে ঘুমাতে পারতেন না। তিনি বলেন, ‘এমন অনেক রাত যায় যখন আমি একদমই ঘুমাতে পারি না। জানাজার শব্দ, মানুষের চিৎকার আর বোমার আওয়াজ সারাক্ষণ আমার মাথায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।’