সময়টা ১৯৪৮ সাল। তরুণী সৌয়াদ আল-আলেম থাকতেন ফিলিস্তিনের আল-মাজদাল শহরে। সে বছর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় শহরটি দখল করে নেয় ইসরায়েল বাহিনী। বাধ্য হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে হয় সৌয়াদকে। শুধু তিনিই নন, ইসরায়েলের আগ্রাসনের মুখে সে সময় আল-মাজদাল ছেড়েছিল শহরটির প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা।
এরপর ৭০ বছরের বেশি সময় গড়িয়েছে। তরুণী সৌয়াদ এখন বৃদ্ধা। বয়স প্রায় ৯০ বছর। তবে ভাগ্য বদলায়নি তাঁর। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নারকীয় বোমা হামলার মুখে এখনো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে সৌয়াদকে। তাঁর মতোই পরিণতি উপত্যকাটির লাখ লাখ ফিলিস্তিনির।
গাজাবাসীর সর্বশেষ এ দুর্দশার শুরু ৭ অক্টোবর থেকে। সেদিন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হঠাৎ হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। এর পর থেকে গাজায় অব্যাহতভাবে বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে ইসরায়েল বাহিনী। এতে নিহত হয়েছেন অবরুদ্ধ উপত্যকাটির প্রায় সাড়ে সাত হাজার বাসিন্দা। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
১৯৪৮-৪৯ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের জেরে প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। তাঁদের অনেকেই ভেবেছিলেন, কিছুদিন পর আবার ফিরে যাবেন। তবে ইসরায়েল তাঁদের প্রতি সদয় হয়নি। তাঁরা কখনোই নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেননি।
নিজের দুর্দশার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে সৌয়াদ বলেন, ‘আকাশে, না হয় নিচে—দিনে ২০ বার আমি মৃত্যুকে দেখি। ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতিটি বোমার বিস্ফোরণ আমাদের মানসিকভাবেও দুর্বল করে দিয়েছে। বোমাগুলো আশপাশে পড়লেও মনে হয়, সেগুলো যেন আমাদের ওপর পড়তে যাচ্ছে।’
সৌয়াদের তরুণ্যের শহর আল-মাজদাল গাজা থেকে বেশি দূরে নয়, মাত্র ১০ কিলোমিটার উত্তরে। বস্ত্রশিল্পের জন্য একসময় জমজমাট ছিল এ শহর, যা ১৯৪৮-৪৯ সালের যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শহরের পুরোনো ভবনগুলো আর নেই। সেখানে এখন ইসরায়েলের সুউচ্চ অট্টালিকা। আগের স্থাপনাগুলোর মধ্যে টিকে আছে শুধু একটি মসজিদ। আল-মাজদাল এখন ইসরায়েলের আশকেলন শহরের অংশ।
১৯৪৮-৪৯ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের জেরে প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। তাঁদের অনেকেই ভেবেছিলেন, কিছুদিন পরে আবার ফিরে যাবেন। তবে ইসরায়েল তাঁদের প্রতি সদয় হয়নি। তাঁরা কখনোই নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেননি। তাঁদের বড় একটি অংশ এখন গাজায় হতদরিদ্র অবস্থায় বসবাস করেন।’ জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী–বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ বলছে, গাজার ৮০ শতাংশের বেশি বাসিন্দাকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে।
৩৫ বছর বয়সী নারী তাঘরিদ এবেয়াদ। তাঁর পূর্বপুরুষেরাও ১৯৪৮ সালে আল-মাজদাল থেকে গাজায় এসেছিলেন। পূর্বপুরুষেরা কেন সব মেনে নিয়ে আল-মাজদাল ছেড়ে এসেছিলেন, এবেয়াদের মনে এ প্রশ্ন শৈশব থেকেই।
যুদ্ধের সেই সময়ের পরিস্থিতিকে ফিলিস্তিনিরা বলেন—‘নাকবা’। আরবি শব্দটি বাংলা করলে দাঁড়ায়—‘বিপর্যয়’। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় একটি শরণার্থীশিবিরের তাঁবুতে বসে সেদিনগুলোর স্মৃতিচারণা করতে করতে সৌয়াদ বলেন, ‘আমি ১৯৪৮ সালের নাকবা দেখেছি। ২০২৩ সালের নাকবাও দেখছি। এখনকার পরিস্থিতি বেশি খারাপ।’
ইসরায়েলের হামলার মুখে ১০ দিনের বেশি সময় আগে নিজের বাড়ি ছেড়ে শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেন সৌয়াদ। তখন থেকে ঠিকমতো খাবার পাচ্ছেন না তিনি। একবারও গোসল করার সুযোগ পাননি। এর ওপর আবার ডায়াবেটিসের রোগী তিনি। ফলে ডায়াবেটিসের জন্য নির্ধারিত খাবার ও ওষুধ বাদে ভীষণ রকমের মানবেতর দিন কাটছে তাঁর।
সৌয়াদ বলেন, ‘আমাদের হাত-মুখ পরিষ্কার করার মতো কিছুই নেই। আমরা পানি দিয়ে ধুতে পারছি না। এখানে কিছুই নেই। বাসায় টয়লেট ছিল। এখানের টয়লেটগুলো খুবই নোংরা। কারণ, সেগুলো অনেক মানুষ ব্যবহার করেন। আমি সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’
১৯৬৭ সালে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সঙ্গে ছয় দিনের যুদ্ধের সময় গাজা দখল করে ইসরায়েল। এরপর প্রায় ৪০ বছর উপত্যকাটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে তারা। ২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজার দখল ছেড়ে দিলে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস। তবে উপত্যকাটির ওপর অবরোধ জারি করে ইসরায়েল ও মিসর। গাজার সঙ্গে এই দুই দেশেরই শুধু সীমান্ত রয়েছে। বলা হয়, এতে উপত্যকাটি বিশ্বের ‘সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগারে’ পরিণত হয়েছে।
গাজায় আজকের দিনে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই পরিচিতি ফিলিস্তিনি শরণার্থী হিসেবে। পরিবার নিয়ে তাঁরা কয়েক প্রজন্ম ধরে সেখানে রয়েছেন। তারপরও ইসরায়েলের হামলার মুখে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা যেসব শহর ও গ্রামগুলো ছেড়ে এসেছিলেন, সেগুলো নিয়ে কথা বলেন তাঁরা।
এমনই একজন ৩৫ বছর বয়সী নারী তাঘরিদ এবেয়াদ। তাঁর পূর্বপুরুষেরাও ১৯৪৮ সালে আল-মাজদাল থেকে গাজায় এসেছিলেন। পূর্বপুরুষেরা কেন সব মেনে নিয়ে আল-মাজদাল ছেড়ে এসেছিলেন, এবেয়াদের মনে এ প্রশ্ন শৈশব থেকেই। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করতাম, পূর্বপুরুষেরা যা করেছেন, তা আমি কখনোই করব না।’
এরপরই আকাশ থেকে লিফলেট ফেলা শুরু করে ইসরায়েল। তাতে সোজাসাপটা নির্দেশ—বাঁচতে চাইলে বাসিন্দাদের উত্তরের গাজা সিটি ছেড়ে দক্ষিণে চলে যেতে হবে। উত্তরে অবিরাম বোমাবর্ষণও শুরু করে ইসরায়েল বাহিনী। এ অবস্থায় এবেয়াদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। পূর্বপুরুষদের মতো তিনি পালাতে বাধ্য হন।
গাজা সিটি থেকে ২০ মাইল হেঁটে খান ইউনিসে যান এবেয়াদ, সঙ্গে পরিবারের আরও ছয় সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি। সব জায়গায় বোমা পড়ছিল। আমরা খান ইউনিসে এলাম। তবে এখানে কিছুই নেই। প্রথম দিন আমাকে ধুলাবালির ওপর ঘুমাতে হয়েছিল। এক সপ্তাহ পর আমার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ল। আশা করি, আবার বাড়ি ফিরে যেতে পারব। অনেক সয়েছি, আর পারছি না।’
এবেয়াদ এখন বুঝতে পারছেন, কেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা ভিটেমাটি ছেড়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ধ্বংসযজ্ঞ, মৃত্যু আর সন্তানদের নিয়ে ভয়, সে সময় তাঁদের পালাতে বাধ্য করেছিল। তবে আমাদের সন্তানদের কাছে এটি কোনো ইতিহাসের কাহিনী হবে না। তারা এখনকার নারকীয় ঘটনাগুলো দেখছে, এর মধ্যেই বড় হচ্ছে।’
ভাষান্তর: শেখ নিয়ামত উল্লাহ