টিফানি ট্রাম্প ও তাঁর বর মাইকেল বুলোস। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে যেতে হোয়াইট হাউস থেকে বের হয়ে তাঁরা মেরিন ওয়ানে যাচ্ছেন, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
টিফানি ট্রাম্প ও তাঁর বর মাইকেল বুলোস। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে যেতে হোয়াইট হাউস থেকে বের হয়ে তাঁরা মেরিন ওয়ানে যাচ্ছেন, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তুর্কি ধনকুবেরের প্রমোদতরিতে ট্রাম্পকন্যার অবকাশ যাপন, শ্বশুর তখন জ্বালানিচুক্তি নিয়ে ব্যস্ত লিবিয়ায়

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ে টিফানি ট্রাম্প ও তাঁর বর মাইকেল বুলোস চলতি বছরের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন করেছেন বিলাসবহুল এক প্রমোদতরিতে। এটির মালিক তুরস্কের এক ধনকুবের, যিনি লিবিয়ার জ্বালানি তেল ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

স্বামীর সঙ্গে টিফানি যখন কোনো সমুদ্র উপকূলে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন, এ সময়েতে টিফানির শ্বশুর ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত মাসাদ বুলোস লিবিয়ায় জ্বালানিচুক্তির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে এমনটি নিশ্চিত করেছে।

উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত তেলসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ার সঙ্গে বুলোস পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা গল্প দীর্ঘদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ কূটনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করে, এটি তার নতুন উদাহরণ হয়ে উঠেছে। সম্পর্কটি বহুস্তরীয় ও জটিল।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, টিফানি ট্রাম্প ও মাইকেল বুলোস এবারের গ্রীষ্মে দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরবর্তী বিলাসবহুল এলাকা ফরাসি রিভিয়েরায় ফিনিক্স-২ নামের একটি প্রমোদতরিতে অবকাশ যাপন করেছেন। প্রমোদতরিটির মালিক তুর্কি ধনকুবের এরকুমেন্ট বায়েগান ও তাঁর স্ত্রী রুইয়া বায়েগান।

বুলোস পরিবার প্রমোদতরিটি ভাড়া নিয়েছিল কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে সর্বশেষ দর অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে ভাড়া ছিল ১৪ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।

টিফানি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চতুর্থ সন্তান। সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজপরিবার আয়োজিত এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় তাঁকে বাবার পাশে দেখা গেছে। সঙ্গে ছিলেন মাইকেল বুলোসও।

টিফানির শ্বশুর মাসাদ বুলোস লেবানিজ বংশোদ্ভূত মার্কিন ব্যবসায়ী। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আরব জনগোষ্ঠীকে ট্রাম্পকে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ট্রাম্প মাসাদকে মধ্যপ্রাচ্য–বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও আফ্রিকার বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব দেন।

তবে মাসাদ প্রথাগত কূটনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। পেশাদার মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ তৈরি হয়। মাসাদ প্রথমে লেবাননে, পরে আফ্রিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। ব্যক্তিগত ব্যবসা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে মিশিয়ে চলার কারণে ট্রাম্প প্রশাসনও হতাশ হয়েছিল বলে মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছে একটি সূত্র।

মিডল ইস্ট আই প্রথম প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, কাতারের রাজধানী দোহায় মাসাদ লিবিয়ার প্রভাবশালী কর্মকর্তা ইব্রাহিম দবিবেহর সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলেন। আলোচনার বিষয় ছিল, লিবিয়ার জব্দ করা কোটি কোটি ডলারের তহবিল উন্মুক্ত করা এবং এর একটি অংশ মার্কিন কোম্পানির কাছে যাওয়া। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস গত বৃহস্পতিবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

২০১১ সালে ন্যাটো-সমর্থিত গণ-অভ্যুত্থানে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হন। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র দেশটির উল্লিখিত তহবিল জব্দ করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তাই জব্দ অর্থ লিবিয়ার জন্য উন্মুক্ত করা হলে সেটি সংস্থার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করতে পারে।

লিবিয়া

২০১১ সালের অক্টোবরে গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হওয়ার পর থেকে লিবিয়া গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। দেশটি বর্তমানে দুই ভাগে বিভক্ত। ত্রিপোলিতে রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার। অন্যদিকে পূর্ব লিবিয়ায় রয়েছে সাবেক জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে।

২০১৯ সালে দুই পক্ষের মধ্যে ত্রিপোলি দখল নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়। পরে এটি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ছায়াযুদ্ধে রূপ নেয়। তুরস্ক জাতিসংঘ–স্বীকৃত সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। রাশিয়া, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) হাফতারকে সমর্থন দেয়। উভয় পক্ষই লিবিয়ার তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে।

মাসাদ বুলোস লিবিয়ায় ইব্রাহিম দবিবেহরের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। ইব্রাহিম ত্রিপোলির সরকার প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দবিবেহরের আত্মীয়। গত জুলাইয়ে তাঁরা সমুদ্রতীরবর্তী ভিলায় একান্ত নৈশভোজে মিলিত হন। তবে এর আগে মাসাদ দেশটির জ্বালানিচুক্তি নিয়ে প্রকাশ্যভাবে কথা বলেছিলেন।

গত আগস্টে মিডল ইস্ট আইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গাজা থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় ইব্রাহিমও যুক্ত ছিলেন। মাসাদের দাবি, তিনি এ আলোচনায় অংশ নেননি।

ফিনিক্স-২ প্রমোদতরিতে টিফানি ও মাইকেলের অবকাশযাপন এই পরিবারের বিলাসি জীবনধারার প্রথম নজরকাড়া ঘটনা নয়; আগেও তাদের ব্যয়বহুল প্রমোদতরিতে অবকাশযাপনের খবর সংবাদ শিরোনামে এসেছে।

গত আগস্টে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ট্রাম্পের অন্য জামাতা ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারকে বিলাসবহুল প্রমোদতরির জন্য অতিরিক্ত ২৫ লাখ ডলার (২৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা) দিতে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ব্রোকারেজ ফার্মের মাধ্যমে কুশনার প্রমোদতরিটি ভাড়া করেছিলেন। মাইকেল বুলোস ওই ফার্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

মাসাদ লেবানিজ বংশোদ্ভূত হলেও আরব নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন। লিবিয়ায় তাঁর কর্মকাণ্ড মিসরের কর্মকর্তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। জুলাইয়ে তিনি তিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি শিশুদের ছবি দেখিয়ে সাইদ বলেন, ‘পুরো মানবজাতির জেগে ওঠার এটাই সময়।’

চলতি গ্রীষ্মে মাসাদ বুলোস মরক্কোর বাদশাহ কিং মোহাম্মদ ষষ্ঠর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছিলেন। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা মরোক্কান অংশীদারদের তাঁর সঙ্গে না বসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফলে বৈঠক হয়নি।