
ক্লোজ শট। ধীরে ধীরে শোনা যায় ভ্রমরের কথা; বোঝা যায়, তাঁর ছেলেবেলার কথা—ভয় ও সংশয়ের। একটু পর দেখা যায় তাঁদের বাড়ি, পরিবার। আরও দেখা যায় ফুলের দুলুনি; শোনা যায় শিশুর হাসি আর কান্না। ভ্রমর ফিরছেন ঘরে। একদিন এই পরিবার থেকে যিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন।
ছুটি কাটাতে আসা বন্ধু অমলের সঙ্গে গ্রাম থেকে বাড়ি ফিরছেন ভ্রমর। পথে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাঁরা একে অপরকে দেখে নেন, কথা বলেন। তারপর অমল বলেন, ‘কী হলো…? তাহলে চলো, ফেরা যাক।’ কিন্তু এমন রোগ ও ভয়ের জন্ম হয়েছে শরীর ও মনে যে এই ফেরা আর আগের মতো হয় না ভ্রমরের। ওদিকে ছুটি শেষে শারীরিকভাবে ফিরলেও অসুস্থ ভ্রমরকে রেখে অমল আর মানসিকভাবে বাড়ি ফিরতে পারেন না।
বিমল করের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত অরুন্ধতী দেবীর পরিচালনায় ১৯৬৭ সালের ছবি ‘ছুটি’র এই দৃশ্যের মতো তেহরানবাসীও ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তারা ফিরছে যুদ্ধ শেষের আনন্দে। কেউ কেউ হয়তো ফিরছে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে। যুদ্ধের ভয়ে এত দিন চোখ পাথরের মতো হয়ে থাকলেও ঘরে ফিরে গুমরে উঠবে বুকের ভেতর। জল চোখে প্রতিনিয়ত ভেসে উঠবে হারানো স্বজনের মুখ। তবু অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর ফের যুদ্ধের আশঙ্কায় তাদের ফেরাটাও হয়তো আগের মতো হচ্ছে না।
সপ্তাহখানেক আগেও তেহরানের রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল সারি সারি গাড়ি। রাস্তাজুড়ে যানজট। ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের কারণে আতঙ্কে ইরানের রাজধানী ছেড়ে চলে যাচ্ছিল মানুষ। অধিকাংশই গাড়িতে; কেউ মোটরসাইকেল আর কেউবা হেঁটেই নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা করেছেন। আবার তেহরানের রাস্তায় একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এবার আর কেউ ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে না। এবার গাড়িভর্তি স্যুটকেস ও পরিবার নিয়ে ঘরে ফিরছে তারা।
আল–জাজিরার বৃহস্পতিবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল-ইরান সংঘাত ১২ দিনব্যাপী চলে। এতে ছয় শতাধিক ইরানি নিহত হয়েছে। আর রাজধানী তেহরান থেকে লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। গত সোমবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর তেহরানবাসী ফিরতে শুরু করেছে। যে তেহরান এখনো ইসরায়েলি বিমান হামলার ক্ষতচিহ্ন বহন করছে।
তবে মানুষ বাড়ি ফিরলেও নিজের ঘরে স্বস্তিতে এখনো ঘুমাতে পারছে না। তাদের আশঙ্কা, যেকোনো সময় আবার শুরু হতে পারে হামলা।
তেহরানের ৩৩ বছর বয়সী গ্রাফিক ডিজাইনার নিকা তাঁর স্বামীর সঙ্গে তেহরান থেকে ২৮৬ কিলোমিটার দূরের জানজান শহরে আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, কয়েক দিন পর বাড়ি ফেরা গেল। এই ফেরা তাঁর কাছে স্বর্গের মতো মনে হচ্ছে। তবে তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত না, যুদ্ধবিরতি আদৌ টিকে থাকবে কি না।’
গত বুধবার ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেস্ট্রি শপ থেকে শুরু করে ডেন্টাল ক্লিনিকসহ বিভিন্ন দোকান ও অফিস তাঁদের গ্রাহকদের খুদে বার্তা পাঠিয়ে জানাচ্ছে, তারা আবার চালু হয়েছে। বিপণিবিতানগুলোও খুলে যাচ্ছে।
পশ্চিম তেহরানের একটি দুগ্ধজাত পণ্যের দোকানের মালিক মরতেজা বলেন, ‘আজ কিছু কিছু গ্রাহক এসেছেন, কিন্তু ব্যবসায় এখনো ধীরগতি।’ তিনি আশা করছেন, আরও মানুষ ফিরলে অবস্থা ভালো হবে। দেশজুড়ে কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর ইন্টারনেট সংযোগও আবার চালু হয়েছে।
তেহরানের ২৬ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী সাবা বলেন, ‘যুদ্ধের আগে আমার জীবন ভীষণ ব্যস্ত ছিল। তেহরানে থাকতাম, চাকরি করতাম, পড়াশোনা করতাম। একা থাকতাম, তাই ঘরের সব কাজও করতাম। যুদ্ধ শুরু হলে প্রথম কিছুদিন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে আমার এই রুটিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি তখনো অফিসে যেতাম, বাজারে যেতাম, ক্যাফেতে যেতাম। কিন্তু একসময় আর অস্বীকার করা যাচ্ছিল না, জীবন থেমে যাচ্ছিল।’
অবশেষে যুদ্ধের পঞ্চম দিনে তেহরান ত্যাগ করতে হয় সাবাকে। তিনি বলেন, ‘প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত হয়, তারপর অফিস জানাল রিমোটে (হোম অফিস) কাজ করতে হবে। একে একে সব বন্ধু শহর ছেড়ে গেল। তখন একটা ভয়ংকর একাকিত্ব অনুভব করলাম। দিনে নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম, কিন্তু রাত নামলেই যখন বোমা হামলা আর আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চালু হতো, তখন আর নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যেত না।’
গাড়ির ব্যবস্থা করতে না পেরে সাবার বাবা উত্তর-পূর্ব ইরানের মাশহাদের কাছের শহর কুচান থেকে এসে তাঁকে তেহরান থেকে নিয়ে যান। সেখানেই কাটে তাঁর যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এই সংঘাতে অন্তত ৬১০ জন নিহত এবং ১ হাজার ৪৮১ জন আহত হয়েছেন। যাঁদের ৯০ শতাংশের বেশি বেসামরিক নাগরিক।
তেহরানের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কামরান (ছদ্মনাম) বলেন, ‘প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তেহরান থেকেই অফিস চালু রাখব। দিনে বোমা হামলা হলেও জীবন চলছিল। কিন্তু রাতগুলো একেবারে অসহনীয় ছিল।’
যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতেই অনেকেই শহর ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাতেও বাধা ছিল—একদিকে পেট্রল পেতে স্টেশনগুলোতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে, অন্যদিকে শহরের বাইরে যাওয়ার সব রাস্তায় তীব্র যানজট ছিল। এখন যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর অনেকেই আবার ফিরে আসছেন শহরে।
নিকা বলেন, ‘১১ দিন কাটিয়েছি এমন জায়গায়, যেখানে যুদ্ধ ছিল না, কিন্তু ছিল না নিজের ঘর, ছিল না শান্তি। তাই নিজের বাসায় ফিরে আসাটাই স্বর্গের মতো। নিজের ঘরের নীরবতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার পর ১১ জন অন্য মানুষের সঙ্গে এক জায়গায় থাকা সত্যিই কঠিন ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি জানি না এই যুদ্ধবিরতি টিকবে কি না। যদি না টেকে, তা–ও আমি আর বাসা ছেড়ে যেতে চাই না।’
ইরানের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ কেভান সাকেত যুদ্ধ চলাকালীন একটি শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখনই তিনি জানতে পারেন তাঁর বাড়িতে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। প্রতিবেশীর কাছ থেকে সেই খবর পেয়ে যুদ্ধবিরতির পর তিনি ফিরে এসেছেন।
কেভান সাকেত আল–জাজিরাকে বলেন, তাঁর বাড়িতে একটি বোমার বিস্ফোরণ না ঘটায় বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে পুলিশ অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা বাড়িতে ঢুকতে পারেননি। পরে বাড়ি ঢুকেই তিনি দেখেন জানালা-দরজা সব ভাঙা, দেয়াল ছিন্নভিন্ন, ফ্রিজ-ওয়াশিং মেশিন ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি লোহার দরজাও বেঁকে গেছে।
কেভান সাকেত বলেন, ‘আমি যুদ্ধ ঘৃণা করি। যারা যুদ্ধ শুরু করে, তাদের আরও বেশি। যুদ্ধ মানবজাতির সবচেয়ে জঘন্য সৃষ্টি।’
যুদ্ধবিরতির পরও দুপক্ষই একে অন্যকে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে। ইরান জানিয়েছে, চুক্তির পরও ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত ছিল, আর ইসরায়েল দাবি করেছে তারা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করেছে। এ অবস্থার মধ্যেই অনেকেই ফিরে আসছেন।
তেহরানে রাজনীতিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হামেদ যুদ্ধবিরতির দিনই কেরমান থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু আবারও চলে যেতে হতে পারে বলে তিনি শঙ্কিত। তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি আমার কাছে বারবার ফিরে আসা দুঃস্বপ্নের মতো। আমি সত্যিই চাই না আবার ব্যাগ গুছিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে যাই। জানি না, তখন আবার ফিরতে পারব কি না!’
এরপরও তেহরানের রাস্তায় প্রাণ ফিরছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের অফিসে ফেরাচ্ছে। রেস্তোরাঁ-ক্যাফে খুলছে। তেহরানসহ আলবোর্জ, পূর্ব আজারবাইজান, ইস্পাহান, ফারস, কেরমানশাহ প্রদেশজুড়ে অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, ১২ দিনে তারা ইরানের শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।
তবু ভোরবেলায় তেহরান শহরের চওড়া সড়কে আবারও গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। সাবা বলেন, ‘আমার মতো অন্যদেরও শহরে ফিরতে দেখা, ক্যাফেগুলো খুলতে দেখা, আবারও জীবনের গতি ফিরতে দেখা—সত্যিই মনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ যদিও ধ্বংস ডেকে এনেছে, তেহরানে কিছুটা সামাজিক সংহতিরও জন্ম দিয়েছে।
তেহরানের ৪০ বছর বয়সী এলমিরা বলেন, ‘মানুষ এখন অনেক বেশি সহানুভূতিশীল ও সাহায্যপ্রবণ। সবার ভেতর একধরনের কমিউনিটি বোধ তৈরি হয়েছে—একসঙ্গে বেঁচে থাকার উপলব্ধি।’
৩৮ বছর বয়সী পেদ্রাম যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স্ক প্রতিবেশীদের জন্য রুটি কিনে দেওয়া বা আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি কাজে সাহায্য করতেন। আবার অনেকেই যুদ্ধের সময় অনাহারে থাকা পথের কুকুর ও বিড়ালদের খেতে দিয়েছেন। পেদ্রাম বলেন, ‘আমার কাছে এটা নৈতিক দায়িত্ব মনে হয়েছে।’
যুদ্ধ শেষ হলেও তেহরানের অনেক বাসিন্দার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। দেশটির অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সিয়ামাক ঘাসেমি তাঁর টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছেন, ‘এখন থেকে তেহরানের যানজট বা দূষণকেও আমরা ভিন্ন চোখে দেখব। আমরা চাই তেহরান বেঁচে থাকুক। আমরা চাই তেহরান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুক। এখন থেকে তেহরান আমাদের কাছে শুধু একটি শহর নয়, অনেক বেশি কিছু।’
তেহরানের শহুরে জীবনে ফিরে আসার এই ক্ষণিক আনন্দের পেছনে এখনো জেগে আছে যুদ্ধবিরতির অনিশ্চয়তা। যেকোনো সময় তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তেহরানবাসীর। তবু এত দিন ফেলে যাওয়া ঘর আর প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার উষ্ণতা অনুভব করছে তারা। অনেকটা ছুটির ওই ভ্রমরের মতো। সবকিছু ক্ষয়ে গেলেও মানুষের ইচ্ছা বা ঘরে ফেরার সুখ চিরন্তন।
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।