ফিলিস্তিনের গাজায় ২১ মাসের বেশি সময় ধরে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এই সময়ে উপত্যকাটিতে হামলা চালিয়ে ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। থমকে আছে যুদ্ধবিরতির আলোচনাও। এরপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আলোচনা চলছে, আগামী সপ্তাহে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে অগ্রগতি হবে বলে আশা করছেন তিনি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে দেশটিতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে জিম্মি করে গাজায় আনা হয় প্রায় ২৫০ জনকে। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, চলমান এই হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৮ হাজার ২৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি।
আজ সোমবারও গাজার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। আল–জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, আজ বিকেলে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হামলায় অন্তত ২৮ জন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) আজ জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজার ‘বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের’ স্থাপনা লক্ষ্য করে তারা শতাধিক হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলের হামলায় আজ সবচেয়ে বেশি ১৭ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন গাজা নগরীসহ উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে। এদিন ভোর থেকে উত্তর গাজার আল–তুফা, আল–সাবরা, আল–সাফতায়ি; মধ্য গাজার নুসেইরাস শরণার্থীশিবির; পূর্ব গাজার সুজাইয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো।
ইসরায়েলে হামলায় হতাহত মানুষের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ওপরও নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। আজ গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংঘাতের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত উপত্যকাটিতে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন চিকিৎসাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্তত ৩৬০ জন চিকিৎসাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসকও রয়েছেন।
আলোচনায় অগ্রগতির আশা ট্রাম্পের
ইসরায়েলের এই নৃশংসতার মধ্যে থমকে রয়েছে গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনা। এর জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে হামাস ও ইসরায়েল। এরপরও স্থানীয় সময় গতকাল রোববার ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, গাজা সংঘাত নিয়ে আলোচনা চলছে, আগামী সপ্তাহে আলোচনায় অগ্রগতি হতে পারে বলে আশা করছেন তিনি।
৬ জুলাই কাতারের দোহায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শুরু আলোচনা হয়। সম্প্রতি দুই পক্ষ ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আশার কথাও জানায়। যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহার চায় হামাস। তবে ইসরায়েল নতুন পরিকল্পনায় উপত্যকাটির ৪০ শতাংশের বেশি এলাকায় সেনা মোতায়েনের কথা উল্লেখ করেছে বলে এএফপিকে জানিয়েছে সূত্র।
ওই সূত্রের দাবি, ইসরালয়েলে ওই পরিকল্পনার জেরে আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ায় হামাস। এমন পরিস্থিতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের দোহা সফরের আগপর্যন্ত আলোচনা স্থগিত রাখার পরামর্শ দেয় মধ্যস্থতাকারীরা। তবে ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা উল্টো অভিযোগ করেছেন, হামাসের ‘একগুঁয়ে’ আচরণের কারণেই আলোচনা থমকে গেছে।
এদিকে আজ বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং এর দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার কথা রয়েছে। তাতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের শীর্ষ কূটনীতিকেরা যোগ দেবেন বলে জানা গেছে। সেখানে পরিবেশ, অর্থনীতি, ব্যবসা, নিরাপত্তা, শান্তি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে সহযোগিতার একটি নতুন সনদ নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
‘বন্দিশিবির’ গড়ছে ইসরায়েল
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যে ‘মানবিক শহর’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছেন, তার সমালোচনা করেছেন দেশটির সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ ও এহুদ ওলমার্ট। রোববার তাঁরা বলেছেন, ইসরায়েলের এই প্রস্তাব ফিলিস্তিনিদের ‘বন্দিশিবিরে’ রাখার মতো।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের প্রধান লাপিদ ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম আর্মি রেডিওকে বলেন, এই পরিকল্পনা ভালো কিছু বয়ে আনবে না। নিরাপত্তা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও লজিস্টিক—সব দিক দিয়ে এটি একটি খারাপ পরিকল্পনা। যাকে ‘মানবিক শহর’ বলা হচ্ছে, তাকে তিনি ‘বন্দিশিবির’ বলতে চান না। তবে সেখান থেকে যদি কেউ বের হতে না পারেন, তাহলে এটি আসলে ‘বন্দিশিবিরই’।
ইসরায়েলের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ‘মানবিক শহর’ গড়ে তোলার পর সেখানে প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে রাখা হবে। বাস্তুচ্যুত এই ফিলিস্তিনিরা বর্তমানে উপত্যকাটির দক্ষিণে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করছেন। একপর্যায়ের গাজার ২০ লাখের বেশি বাসিন্দাকে সেখানে নেওয়া হবে। স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে দেখা গেছে, এমন শহর গড়ে তোলার জন্য রাফায় প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল।
এই শহর নিয়ে ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওহুদ ওলমার্ট সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘আমি দুঃখিত। তবে এটি বন্দিশিবিরই।’