মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ডোনাল্ড ট্রাম্প
মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মুসলিম নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের মধ্যেই গাজায় তীব্র হামলা

ফিলিস্তিনের গাজা নগরীর আরও ভেতরে অগ্রসর হয়েছেন ইসরায়েলি সেনারা। বড় বড় ভবন লক্ষ্য করে যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা হচ্ছে বোমা। শুধু গাজা নগরী নয়, পুরো গাজা উপত্যকায় চলছে ইসরায়েলি আগ্রাসন। এ কারণে গত মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত অন্তত ৮৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

গাজায় ইসরায়েলের চলা আগ্রাসন নিয়ে মুসলিম আট দেশের নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের মধ্যেই এমন নৃশংসতা চালানো হয়। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের ফাঁকে মঙ্গলবার এ বৈঠক হয়।

ট্রাম্পের সঙ্গে যেসব দেশের নেতাদের বৈঠক হয়েছে, সেগুলো হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মিসর, জর্ডান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান। গত রবি ও সোমবার ফিলিস্তিনকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ১০ দেশের স্বীকৃতির পর এ বৈঠক নিয়ে বেশ আলোচনা ছিল।

মঙ্গলবারের বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। এ সময় মুসলিম নেতাদের সঙ্গে এই বৈঠককে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা এই যুদ্ধ শেষ করতে চাই।’ আর বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেন, ‘বৈঠক “ফলপ্রসূ” হয়েছে।’

ট্রাম্প সংঘাত শেষ করার কথা বললেও গাজায় ইসরায়েলের চলা আগ্রাসনের বড় সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রই। প্রায় দুই বছর ধরে চলা এই আগ্রাসনে ওয়াশিংটনের এককাট্টা সমর্থন পাচ্ছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্র দিয়ে অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চলছে হামলা। সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোরও কড়া সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প।

বৈঠকে কী হলো

ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান, জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রাবোও সুবিয়ান্তো, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, আরব আমিরাতের উপপ্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ও মিসরের প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা মাদবৌলি।

বৈঠকের আগে এ দেশগুলোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ইসরায়েল ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সব দেশের সঙ্গে এক টেবিলে বসবেন তিনি। এরপর ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের।

বৈঠকের পর বিস্তারিত কিছু না জানিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে শুধু হাত নাড়ান ট্রাম্প। বিস্তারিত জানায়নি হোয়াইট হাউসও। তবে বুধবার রাতে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতাদের একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়েছে, বৈঠকে মুসলিম দেশগুলোর নেতারা গাজায় অসহনীয় পরিস্থিতি, মানবিক বিপর্যয় ও বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনির নিহত হওয়ার বিষয়টি ট্রাম্পের কাছে তুলে ধরেছেন।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসপিএ প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকে গাজা সংঘাত বন্ধের ওপর গুরুত্ব দেন মুসলিম নেতারা। তাঁরা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হচ্ছে গাজায় প্রয়োজনীয় ত্রাণ প্রবেশ করতে দেওয়া ও উপত্যকাটিতে বন্দী জিম্মিদের মুক্তির জন্য দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি। এ ছাড়া পশ্চিম তীর ও গাজায় স্থিতিশীলতার জন্য একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। আরব ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পরিকল্পনার ভিত্তিতে গাজা পুনর্গঠনের ওপরও গুরুত্ব দেন মুসলিম নেতারা।

‘বৃষ্টির মতো’ বোমাবর্ষণ হচ্ছে

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এ ঘটনায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। সেদিন থেকেই গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণ—সর্বত্র নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে ১৬ সেপ্টেম্বর গাজা নগরীতে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে সেখানকার প্রায় ১০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে সাড়ে চার লাখের বেশি গাজার দক্ষিণ পাশে চলে গেছেন।

ইসরায়েলের দাবি, হামাস নিধনের জন্য গাজা নগরীতে তাদের এ অভিযান। যদিও ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় যাঁরা নিহত হচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই সাধারণ ফিলিস্তিনি। যেমন বুধবার নগরীর মধ্যাঞ্চলে বাস্তুচ্যুত একাধিক পরিবারের আশ্রয় নেওয়া একটি ভবনে হামলা হয়। এতে বেসামরিক ২০ ফিলিস্তিনি নিহত হন। পাশের একটি আবাসিক ভবনে হামলায় নিহত হন আরও ২ জন।

গাজা নগরীর প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শহরের উপকণ্ঠে জনবসতিপূর্ণ তেল আল-হায়া এলাকায় ট্যাংকের উপস্থিতি বাড়িয়েছে ইসরায়েল। আরও ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে আল-কুদস হাসপাতালের কাছে। গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফার কাছেও অবস্থান করছে ইসরায়েলি ট্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোয় হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ফিলিস্তিনিরা।

আকাশপথেও হচ্ছে হামলা। মধ্য গাজা থেকে আল-জাজিরার সাংবাদিক তারেক আবু আজোউম জানান, নগরীতে ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতার খবর পাচ্ছেন তাঁরা। ফিলিস্তিনিদের ঘুমের মধ্যেই বোমাবর্ষণ করে হত্যা করা হচ্ছে। শহরে এখনো টিকে থাকা বহুতল ভবনগুলোয় যুদ্ধবিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে। ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে শহরের আকাশ।

গাজার স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে উপত্যকাটিতে অন্তত ৬৫ হাজার ৪১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।

‘আরও অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে’

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ইসরায়েল–ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ দূত ওফার ব্রনসটাইন বলেছেন, আরও কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশও থাকতে পারে। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়া ফ্রান্সের প্রতিনিধিদলে রয়েছেন ওফার ব্রনসটাইন।

আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রনসটাইন বলেন, ট্রাম্প ও ইসরায়েল সরকার অনেক কথা বলছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এবং হামাসের হাতে থাকা বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার পর কী হবে, সে বিষয়ে দুই পক্ষের কেউই বাস্তবসম্মত কোনো প্রস্তাব দিচ্ছে না। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধান কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে করতে হবে। সহিংসতা ও যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়।

‘ট্রাম্পের মন্তব্য ছলনাময়’

গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর গাজায় সংঘাত থামাতে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এ প্রচেষ্টার মধ্যে গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতা কমেনি, বরং বেড়েছে। এ ছাড়া সংঘাত থামানোর চেষ্টা করলেও গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে সেখানে ‘প্রমোদকেন্দ্র’ বানানোর কথাও তুলেছিলেন ট্রাম্প।

সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ট্রাম্পের নানা বক্তব্যে তাঁর সেই আগের অবস্থানই দেখা যাচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন দেশের নেতারা গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতার সমালোচনা করলেও একবারের জন্য এ বিষয়ে মুখ খোলেননি তিনি। জাতিসংঘের অধিবেশনে ট্রাম্প এ-ও বলেছেন, ‘আমি ইসরায়েলের পক্ষে। সত্যি বলতে সারা জীবন আমি ইসরায়েলের পক্ষে ছিলাম।’

এমন পরিস্থিতিতে গাজায় সংঘাত থামানো নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যকে ‘ছলনাময়’ বলে উল্লেখ করেছেন ইস্তাম্বুল জাইম ইউনিভার্সিটির শিক্ষক সামি আল-আরিয়ান। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এই বক্তব্য ছলনাময়। মার্কিনরা সৎ মধ্যস্থতাকারী নয়। গাজায় আগ্রাসনে শুধু ইসরায়েলই নয়, মার্কিনরাও জড়িত।’