
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বাশার আল-আসাদের পতনের প্রায় দুই মাস পর দেশটির সাবেক বিরোধী কমান্ডার এবং বর্তমানে কার্যত নেতা আহমেদ আল-শারাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করা হয়েছে। সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
দামেস্ক থেকে আল–জাজিরার প্রতিবেদক ওসামা বিন জাভাইদ বলেন, ‘এটি একটি স্মরণীয় দিন। এর মধ্য দিয়ে দেশটির ভবিষ্যতের পথচলা আরও বেশি স্পষ্ট হবে। কারণ, এত দিন পর্যন্ত নতুন প্রশাসন কেমন হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল।’
আল-শারা এক সময় মোহাম্মদ আল-জোলানি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সিরিয়ার অন্যতম বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসের নেতা। গোষ্ঠীটি সিরিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়ে গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের অভিযানে নেতৃত্ব দেয়।
সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থার এক প্রতিবেদনে নতুন সামরিক পরিচালনা খাতের মুখপাত্র কমান্ডার হাসান আবদেল গনির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচন হওয়ার আগপর্যন্ত আল-শারাকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করা হয়েছে। তাঁকে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য একটি অস্থায়ী আইন পরিষদ গঠনে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। একটি নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগপর্যন্ত আইন পরিষদ কার্যকর থাকবে।
সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী এমনকি আল-শারার নিজের সশস্ত্র সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামসহ (এইচটিএস) সিরিয়ার সব সামরিক গোষ্ঠী বিলুপ্ত করা হয়েছে। একইভাবে দেশটির সংবিধান এবং বাশার আল-আসাদের দল বাথ পার্টিকেও বিলুপ্ত করা হয়েছে। বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগপর্যন্ত ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে দলটি সিরিয়ার ক্ষমতায় ছিল।
দামেস্কে গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আল-শারাকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করার ঘোষণা আসে। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আল-শারার এইচটিএসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী লড়াই করেছে, সেগুলোর কমান্ডারদের নিয়ে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আল–জাজিরার প্রতিবেদক ওসামা বিন জাভাইদ বলেন, ‘(আল-শারা) তাঁদের (কমান্ডার) আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন, তাঁরা কেবল প্রতিনিধিত্বই করবেন না, বরং একটি নতুন সিরিয়ার অংশও হবেন।’
আমরা জানি না, অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হবে। কারণ, সিরিয়ায় বর্তমানে নির্বাচনের জন্য কোনো সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়নি।
এর আগে আল-শারা বলেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে একটি নির্বাচনের আয়োজন করতে চার বছরের মতো সময় লেগে যেতে পারে।
সৌদি আরবের সম্প্রচারমাধ্যম আল আরাবিয়াকে গত ডিসেম্বরে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আল-শারা বলেছিলেন, নতুন একটি সংবিধানের খসড়া করতে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
আল-শারা আরও বলেন, চার বছর পর নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হতে পারে। কারণ, দেশটির যোগ্য ভোটার সংখ্যা নিরূপণের জন্য একটি নতুন আদমশুমারি করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘যেকোনো অর্থবহ নির্বাচনের জন্য ব্যাপক পরিসরে একটি আদমশুমারি দরকার।’
আল-শারা এক সময় মোহাম্মদ আল-জোলানি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সিরিয়ার অন্যতম বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসের নেতা। গোষ্ঠীটি সিরিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়ে গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের অভিযানে নেতৃত্ব দেয়।
এইচটিএস এক সময় আল-কায়েদার অধিভুক্ত ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গোষ্ঠীটি নিজেদের মধ্যপন্থী করার চেষ্টা করেছে। আল-শারা নিজেকে এবং তাঁর দলকে বাশার আল-আসাদের হাত থেকে মুক্ত সিরিয়ার জন্য বিশ্বাসযোগ্য রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন। ২০১১ সালে বাশার আল-আসাদ আরব বসন্ত চলাকালে শক্ত হাতে এবং নৃশংসভাবে সিরিয়ার বিদ্রোহ দমন করেছিলেন।
বাশার আল-আসাদের অপসারণের পর থেকে এইচটিএস কার্যত সিরিয়ার ক্ষমতাসীন দলে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্রোহী অধ্যুষিত ইদলিব অঞ্চলে নিজেদের স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় আল-শারা বিদেশি নেতা এবং কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কৌঁসুলি করিম খানের সঙ্গে দেখা করেছেন।
চলতি সপ্তাহে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দামেস্কের পরিস্থিত স্থিতিশীল করতে সাহায্য করার জন্য ইইউর বৃহত্তর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সিরিয়ার ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ ২০১১ সালে সিরিয়ার ওপর একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এর ফলে বিভিন্ন পুঁজিবাজারের দামেস্কের প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে যায় এবং বাণিজ্যিক আয় বাধাগ্রস্ত হয়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো সিরিয়ার আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
আল-শারা এবং তাঁর সরকার বিদেশি নেতাদের স্পষ্ট করে দিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সিরিয়ার ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাশার আল-আসাদ সরকারের অবশিষ্ট অংশগুলোও ভেঙে দেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে পার্লামেন্ট, সিরিয়ার পুরোনো সংবিধান এবং আল-আসাদের আরব সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টি।
বাথ পার্টির ঘোষিত লক্ষ্য ছিল আরব রাষ্ট্রগুলোকে এক জাতিতে পরিণত করা। সিরিয়ার দুই আরব জাতীয়তাবাদী মিশেল আফলাক এবং সালাহ আল-দিন আল-বিতার দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে দলের প্রথম নীতিমালা গৃহীত হয়েছিল। এক সময় দলটি দুটি আরব দেশ ইরাক এবং সিরিয়া শাসন করেছিল।
সিরিয়ায় বাথ পার্টি বাশার আল-আসাদের পরিবারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছিল, যারা ১৯৭০ সালে দেশটির ক্ষমতায় আসে। কয়েক দশক ধরে পরিবারটি সিরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে দলটিকে এবং এটির প্যান-আরব মতাদর্শকে ব্যবহার করেছে। অনেক উচ্চপদস্থ সামরিক পদে এই পরিবারের সংখ্যালঘু আলাউত সম্প্রদায়ের সদস্যরা অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং দলের সদস্যপদকে সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদী চরিত্র দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁর বাথ পার্টির অনেক নেতা গা ঢাকা দিয়েছেন কিংবা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। একটি প্রতীকী উদ্যোগ হিসেবে সিরিয়ার নতুন শাসকেরা দামেস্কে বাথ পার্টির সাবেক প্রধান কার্যালয়কে একটি কেন্দ্রে পরিণত করা হয়, যেখানে সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য ও নিরাপত্তা বাহিনী সারি বেঁধে নিজেদের নাম নিবন্ধন করেন এবং অস্ত্র সমর্পণ করেন।