
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বিপর্যস্ত করতে এবং পরমাণু বোমা তৈরিতে যাতে আরও বিলম্ব হয়—এ উদ্দেশ্যে দেশটিতে নজিরবিহীনভাবে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
তবে হামলার ধরন, লক্ষ্যবস্তু ও ইসরায়েলি নেতাদের বক্তব্য থেকে অন্য কিছুর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সব দেখে-শুনে অনেকে বলছেন, শুধু পরমাণু বিষয় নয়, হামলার উদ্দেশ্য আরও বড় হলেও হতে পারে। সম্ভবত ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছে ইসরায়েল।
গত শুক্রবার ভোররাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও ক্ষেপণাস্ত্র কারখানার পাশাপাশি দেশটির সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদেরও নিশানা করে হামলা চালায় ইসরায়েল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের ভেতরে ও আঞ্চলিক মিত্রদের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করাই ছিল হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রথম দফার হামলায় ইরানের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরবর্তী হামলাগুলোও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে, ক্ষয়ক্ষতি হু হু করে বাড়ছে। এতে দেশটির বর্তমান শাসনব্যবস্থা দুর্বল ও অস্থির হয়ে পড়তে পারে।
এ ধরনের পরিস্থিতি ইরানের ভেতরে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দিয়ে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। প্রতিবেশী মিত্রদের কাছেও ইরানের ভাবমূর্তি দুর্বল হতে পারে। তবে পাল্টা হামলা চালিয়ে ইরানও এখন তাদের শক্তির জানান দিচ্ছে।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির মাইকেল সিং বলেন, আংশিকভাবে (ইরানের) শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের আশায় ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে, এমনটি ধরে নেওয়া যেতে পারে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা (ইসরায়েল) চায় ইরানের জনগণ রাস্তায় নামুক, প্রতিবাদ করুক।’ তাঁর মতে, প্রথম দফার হামলায় সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কম। এটা থেকে বোঝা যায়, ইসরায়েলের লক্ষ্য শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিকও।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কয়েক ঘণ্টা পর এক ভিডিও বার্তায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘ইসলামি শাসনব্যবস্থার নামে প্রায় ৫০ বছর ধরে আপনাদের দমন করা হচ্ছে। এখন সেই শাসনই ইসরায়েলকে ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে।’
ইরানের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি নস্যাৎ করাই ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য ছিল জানিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। পাশাপাশি আপনাদের স্বাধীনতার পথও খুলে দিচ্ছি।’
নেতানিয়াহু বলেন, ‘কীভাবে আঘাত করা হয়েছে (ইরানের) এই শাসকগোষ্ঠী তা বুঝতেই পারেনি কিংবা সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা-ও তারা বুঝতে পারছে না। তারা এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় আছে। এটাই আপনাদের সুযোগ। উঠে দাঁড়ান, কথা বলুন, নিজেদের আওয়াজ পৌঁছে দিন।’
ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও তাতে বর্তমান শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে সন্দেহ আছে। কারণ, কয়েক দশক ধরে দেশটির শাসকগোষ্ঠীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে। তাই এত বড় হামলার পরও সেখানে সরকারবিরোধী জনমত কতটা গড়ে উঠবে, তা নিশ্চিত নয়। এ ছাড়া দেশটির শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনী এখনো শাসকদের প্রতি অনুগত।
বিশ্লেষক মাইকেল সিং মনে করেন, ইরানে বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কী ধরনের পরিস্থিতি দরকার, তা কেউ জানে না।
শুক্রবারের হামলাকে ইসরায়েলের দীর্ঘ পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা অব্যাহত রাখবে ইসরায়েল, যাতে তেহরান পরমাণু বোমা তৈরির পথে এগোতে না পারে। তবে একা ইসরায়েলের পক্ষে ইরানের পুরো পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার ক্ষমতা নেই।
ইরান বারবার বলে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) চলতি সপ্তাহে বলেছে, ইরান বৈশ্বিক পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
ইসরায়েলের প্রথম দফার হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করা হয়েছে। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বড় একটি অংশ ধ্বংস করা হয়েছে। পাশাপাশি ভূমিতে স্থাপিত একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ধ্বংস করা হয়েছে।
ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইসরায়েল একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমরা বিশ্বাস করি, কোনো দেশের জনগণই নিজেদের সরকার নির্বাচনের অধিকার রাখে। ইরানের জনগণই নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।’
নেতানিয়াহু আগেও ইরানের সরকার পরিবর্তনের কথা বলেছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরেও তিনি এমন কথা বলেছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার হামলায় ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছে এবং ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে সহায়তা করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানে সরকার পরিবর্তনের পক্ষে নয়।
এ বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে রয়টার্সের তরফে যোগাযোগ করা হলেও হোয়াইট হাউস ও জাতিসংঘে ইরানের মিশন তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানায়নি।