
বাণিজ্যিক কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি ইঙ্গিত দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনাটি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সম্ভবত ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে গতকাল রোববার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক গভীরে অবস্থিত। সেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সেন্ট্রিফিউজ রাখা ছিল।
জাতিসংঘের সাবেক পারমাণবিক পরিদর্শক এবং ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রধান ডেভিড অলব্রাইট বলেন, ‘তারা শুধু এমওপি দিয়ে সরাসরি আঘাত করেছে। এমওপি বলতে তিনি ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বা বাংকার-বিধ্বংসী বোমা বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘স্থাপনাটি সম্ভবত একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’
তবে সিএনএ করপোরেশনের সহযোগী গবেষক ও কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি বিশেষজ্ঞ ডেকার ইভেলেথ বলেন, ভূগর্ভস্থ স্থাপনাটির ধ্বংস হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করা যায়নি। তিনি আরও বলেন, ‘শত শত সেন্ট্রিফিউজ থাকা হলটি এতটাই গভীরে অবস্থিত যে কৃত্রিম উপগ্রহের ছবির ভিত্তিতে এর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন, ইরান সম্ভবত গতকাল মার্কিন হামলার আগে ফর্দো থেকে প্রায় অস্ত্র তৈরির উপযোগী উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত সরিয়ে নিয়েছে।
গতকাল রোববার সকালে যুক্তরাষ্ট্র যে হামলা চালিয়েছে, সে ধরনের হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইরান তাদের পারমাণবিক কার্যক্রমের একটি বড় অংশ ভূগর্ভস্থ সুরক্ষিত স্থানে লুকিয়ে রেখেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতে দেখা গেছে, বাংকার-বিধ্বংসী বোমাগুলো যেখানে পাহাড় ভেদ করেছে বলে মনে হচ্ছে, সেখানে ছয়টি গর্ত তৈরি হয়েছে। এর আশপাশের মাটি ওলটপালট হয়ে গেছে এবং ধুলায় ঢেকে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বলেছে, তারা তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে চায়।
তবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও সরঞ্জামগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলে দেশটি হয়তো সহজেই আবার তার অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করতে পারবে, যা ২০০৩ সালে বন্ধ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বলেছে, তারা তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে চায়।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন, ইরান সম্ভবত গতকাল মার্কিন হামলার আগে ফর্দো থেকে প্রায় অস্ত্র তৈরির উপযোগী উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত সরিয়ে নিয়েছে। অন্যান্য পারমাণবিক উপাদানসহ এগুলো এমন স্থানে লুকিয়ে রেখেছে, যা সম্পর্কে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের পরিদর্শকেরা জানেন না। তাঁরা উল্লেখ করেছেন, ম্যাক্সার টেকনোলজিসের কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার ফর্দোতে ‘অস্বাভাবিক তৎপরতা’ দেখা গেছে। এটির একটি প্রবেশপথের বাইরে অনেকগুলো যানবাহনের দীর্ঘ সারি ছিল।
গতকাল ইরানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, অস্ত্র তৈরির উপযোগী মানের কাছাকাছি ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে একটি অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের উপকূলীয় শহর মন্টেরিতে অবস্থিত মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জেফরি লুইস বলেন, ‘আমার মনে হয় না আপনি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারবেন, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি থামানো গেছে। হয়তো কয়েক বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া গেছে মাত্র। প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তাদের এমন স্থাপনাও আছে, যেগুলোর কথা আমাদের জানা নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের সিনেটর মার্ক কেলিও একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি একজন ডেমোক্র্যাট ও সিনেট গোয়েন্দা কমিটির সদস্য। তিনি প্রতিদিন সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনা করছেন বলেও জানিয়েছেন।
মার্ক কেলি এনবিসি নিউজকে বলেন, ‘এখন আমার সবচেয়ে বড় ভয় হলো, তারা এই পুরো কর্মসূচি ভূগর্ভে নয়, বরং আড়ালে নিয়ে যাবে।’
মার্ক কেলি আরও বলেন, ‘আমরা যেখানে এই কর্মসূচি থামাতে চেয়েছিলাম, সেখানে হয়তো এটি আরও গতিশীল হবে।’
ইরান বহুদিন ধরেই বলে আসছে, তারা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
তবে ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের পার্লামেন্ট ১৯৭০ সালে হওয়া পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি দিচ্ছে এবং আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করার কথাও বলছে।
আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন নামের সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড্যারিল কিমবল বলেন, ‘ইরান কী করছে, তা নিয়ে বিশ্ব অন্ধকারে থাকবে।’
রয়টার্স চারজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে, যাঁরা ম্যাক্সার টেকনোলজিসের কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করেছেন। ছবিতে পাহাড়ের নিচে যেখানে সেন্ট্রিফিউজ হলটি থাকার কথা, সেখানে দুটি ভাগে ছয়টি গর্ত দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইন সাংবাদিকদের জানান, সাতটি বি-২ বোমারু বিমান ১৪টি জিবিইউ-৫৭/বি এমওপি নিক্ষেপ করেছে। এগুলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ৩০ হাজার পাউন্ডের বোমা হামলা চালাতে সক্ষম। ২০১২ সালের কংগ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব বোমা মাটির ২০০ ফুট গভীরে প্রবেশ করে ফর্দোর মতো সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম।
তবে ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সংসদ ১৯৭০ সালে হওয়া পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি দিচ্ছে এবং আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করার কথাও বলছে।
কেইন বলেন, প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, স্থাপনাগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কোনো পারমাণবিক স্থাপনা অক্ষত আছে কি না, সে বিষয়ে আগেভাগেই কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
সিএনএ করপোরেশনের সহযোগী গবেষক ও কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি–বিশেষজ্ঞ ডেকার ইভেলেথ বলেন, ম্যাক্সারের ছবি এবং কেইনের মন্তব্য ইঙ্গিত করে, প্রথমে ফর্দোতে ছয়টি এমওপি ফেলা হয়, তারপর ঠিক একই স্থানে আরও ছয়টি বোমা ফেলা হয়, যাকে বলা হয় ‘ডাবল ট্যাপ।’
ডেকার বলেন, তেহরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজ ও ইস্পাহান লক্ষ্য করেও হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।