ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

যুদ্ধের বিপক্ষে ইসরায়েলের ৭০ শতাংশ মানুষ, তবুও হামলা চালাবেন নেতানিয়াহু

ফিলিস্তিনের গাজায় এত মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের পরও নৃশংসতা থামাতে রাজি নন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গতকাল শনিবার তিনি বলেছেন, উপত্যকাটিতে হামলা চালানো ছাড়া ইসরায়েলের সামনে ‘আর কোনো পথ খোলা’ নেই। প্রতিবেশী দেশ ইরান যেন কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র না পায়, তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।

গাজায় ১৮ মাসের বেশি সময় ধরে চরম নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে নির্মূল করতেই এ হামলা চালানো হচ্ছে বলে দাবি ইসরায়েলের। তবে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা গাজায় বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত উপত্যকাটিতে ৫১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

ইসরায়েলি হামলায় ঘরবাড়ি হারিয়ে ধ্বংসস্তূপের মাঝে শিশুসন্তানকে নিয়ে বসে আছেন এক ফিলিস্তিনি নারী। ফিলিস্তিনের গাজায়

শনিবার রাতে এক ভিডিও বক্তৃতায় নেতানিয়াহু বলেন, বিজয়ের আগপর্যন্ত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ইসরায়েলের সামনে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তিনি আরও বলেন, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব হামাস প্রত্যাখ্যান করাটা, উপত্যকায় বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাওয়ার একটি কারণ।

সম্প্রতি গাজায় আংশিক যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দিয়েছিল ইসরায়েল। তাতে উপত্যকাটিকে অস্ত্রমুক্ত করার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। তবে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের কথা বলা হয়নি। এই শর্ত মানতে নারাজ হামাস। নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েল যদি হামাসের দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে দেশটির সেনা, নিহত ও আহত ‘বীরেরা যে অসাধারণ অর্জন করেছেন’, তা হারিয়ে যাবে।

ভিডিও বক্তৃতায় ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়েও কথা বলেন নেতানিয়াহু। শনিবার এই প্রকল্প নিয়ে ইতালির রাজধানী রোমে বৈঠক করেছে তেহরান ও ওয়াশিংটন। নেতানিয়াহু বলেন, ‘ইরানের পরমাণু অস্ত্র হাতে পাওয়া ঠেকাতে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই (প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে) আমি হাল ছেড়ে দেব না। আমি এটি হতে দেব না।’

‘আমি মারা গেলে ভালো হতো’

গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে। দীর্ঘ ১৫ মাস পর ১৯ জানুয়ারি থেকে সেখানে যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও ১৮ মার্চ থেকে আবার তীব্র হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। শনিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, আগের ৪৮ ঘণ্টায় উপত্যকাটিতে ইসরায়েলের হামলায় ৯০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

এ ছাড়া শনিবার রাতে ইসরায়েলের হামলায় নারী-শিশুসহ আরও ১৫ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে দক্ষিণে খান ইউনিসে চালানো হামলায়। এই ফিলিস্তিনিদের অনেকে মুয়াসি এলাকায় আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত। হাসপাতালের কর্মীরা জানিয়েছেন, এই এলাকাকে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছিল ইসরায়েল।

একটি দাতব্য সংস্থার রান্না করা খাবার সংগ্রহের অপেক্ষায় ফিলিস্তিনের শিশুরা। উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায়

নিহতদের মধ্য এক শিশুও রয়েছে। মরদেহ ব্যাগে ভরার সময় এক ভাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘ওমর চলে গেল...আমি ওর জায়গায় থাকলে ভালো হতো।’ শনিবার রাতে অন্য চারজন নিহত হয়েছেন দক্ষিণে রাফায়। স্থানীয় ইউরোপীয় হাসপাতালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের মধ্যে এক নারী ও তাঁর শিশুসন্তান রয়েছেন।

এদিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, শনিবার উত্তর গাজায় তাদের এক সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর এই প্রথম গাজায় দেশটির কোনো সেনা নিহত হলেন বলে জানিয়েছে তারা। এদিন উত্তরে গাজা নগরীর আল-তুফা এলাকার উপকণ্ঠে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর খবর জানিয়েছে হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসেম ব্রিগেড।

যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ

২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের হামলা হামাসের হামলার পরই মূলত গাজায় হামলা শুরু করে দেশটি। সেদিন ইসরায়েল থেকে প্রায় আড়াই শ ব্যক্তিকে জিম্মি করে হামাস। সংগঠনটির হাতে এখনো ৫৯ জিম্মি রয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার। তাঁদের ফেরাতে এবং গাজায় হামলা বন্ধের জন্য ইসরায়েলের অভ্যন্তরে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে।

জিম্মিদের ফেরানোর জন্য যুদ্ধবিরতির দাবিতে এরই মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীর হাজার হাজার সাবেক ও বর্তমান সদস্য এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ থেকে এমন চিঠি প্রকাশের সংখ্যা বাড়ছে। আর গত মাসে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম চ্যানেল টুয়েলভ নিউজের জরিপে দেখা যায়, জিম্মিদের ফেরানোর জন্য যুদ্ধ বন্ধের চুক্তির পক্ষে দেশটির প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ।

এদিকে শনিবার রাতেও জিম্মিদের ফেরাতে একটি চুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ইসরায়েলের নাগরিকেরা। তেল আবিবে এক বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া ওমের শেম তোভ। তিনি বলেন, ‘তাঁদের (জিম্মি) এখনই ফেরত আনুন। একটি চুক্তি করুন। এর জন্য যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে হয়, তা-ই করুন।’