
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। গতকাল রোববার দেশগুলো আলাদাভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১৫০টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল।
গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে চলমান ইসরায়েলের গণহত্যার মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে এসব শক্তিধর দেশের স্বীকৃতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এই স্বীকৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে। যথারীতি তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইসরায়েল।
গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক ভিডিও বার্তায় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বক্তব্যের শুরুতে স্টারমার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান বীভৎসতার মুখে আমরা শান্তির সম্ভাবনা এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করছি। এর অর্থ হলো একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি একটি কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, এ মুহূর্তে যার কোনোটিই আমাদের কাছে নেই।’
এরপর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় হয়েছে। শান্তি ও দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান পুনরুজ্জীবিত করার আশায় আজ আমি এই মহান দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি, যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।’
গত জুলাই মাসেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। তখন স্টারমার প্রশাসন বলেছিল, ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির শর্ত পূরণে রাজি না হয় এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই শান্তি স্থাপনে চুক্তি না করে, তাহলে যুক্তরাজ্য সরকার নিজেদের অবস্থান বদলাবে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।
পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও লুক্সেমবার্গও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ফিলিস্তিনকে পশ্চিমা দেশের স্বীকৃতির ঘোষণা ভালোভাবে নেয়নি ইসরায়েল। এরই মধ্যে ইসরায়েল বলেছে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ‘সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত’ করা হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান বীভৎসতার মুখে শান্তির সম্ভাবনা ও দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করছি।কিয়ার স্টারমার, প্রধানমন্ত্রী, যুক্তরাজ্য
ভিডিও বার্তায় স্টারমার ইসরায়েলের এ অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আহ্বান বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত। এই সমাধানের অর্থ হামাসকে পুরস্কৃত করা নয়। এর অর্থ, এখন হামাসের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সরকারে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না এবং নিরাপত্তাব্যবস্থায়ও কোনো অংশীদারত্ব থাকবে না।’
গতকাল সবার আগে কানাডার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসে। এর মধ্য দিয়ে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিনকে সবার আগে স্বীকৃতি দেওয়ার গৌরব অর্জন করে কানাডা।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এক্সে এক পোস্টে বলেন, ‘কানাডা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয়ের জন্য শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি আমরা আমাদের অংশীদারত্ব প্রস্তাব করছি।’
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ বলেন, অস্ট্রেলিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এতে অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘদিনের বৈধ রাষ্ট্র প্রত্যাশা স্বীকার করছে। এই স্বীকৃতিতে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হয়েছে। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ের জন্য স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার একমাত্র পথ।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি অঞ্চলটিতে স্থায়ী শান্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তাঁর কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক বৈধতার সঙ্গে ন্যায়সংগত ও স্থায়ী শান্তি অর্জনের পথে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর দেশটির যুক্তরাজ্য মিশনের প্রধান হুসাম জুমলত বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এটি ফিলিস্তিনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার মুহূর্ত।’ এখানে তিনি ১৯৯০–এর দশকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসনব্যবস্থার পতনের প্রসঙ্গ টানেন। তাঁর মতে, ফিলিস্তিনও এখন সেই পথের দিকে এগোচ্ছে।
এদিকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসও স্বীকৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলেছে, ‘এই স্বীকৃতি আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের ভূমি ও পবিত্র স্থানের অধিকার এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার নিশ্চিত করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’ হামাসকে যুক্তরাজ্যসহ অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে।
এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয়ের জন্য শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি আমাদের অংশীদারত্ব প্রস্তাব করছি।মার্ক কার্নি, প্রধানমন্ত্রী, কানাডা
যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতির পর এক্সে এক পোস্টে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হলো, সরাসরি জিহাদি হামাসকে পুরস্কৃত করা।
স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলোর উদ্দেশে এক ভিডিও বার্তায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘আপনাদের জন্য আমার আরেকটি বার্তা আছে। তা হলো, এটা হবে না। জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে না।’ আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম বার্ষিক অধিবেশনে এই স্বীকৃতির বিরোধিতা করারও ঘোষণা দেন তিনি।
গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকাটির প্রায় ২১ লাখ বাসিন্দার প্রায় সবাই একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সম্প্রতি গাজার বৃহত্তম শহর গাজা নগরীতে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।
এদিকে জাতিসংঘ স্বীকৃত রোমভিত্তিক খাদ্যনিরাপত্তা পর্যবেক্ষণবিষয়ক প্যানেল (আইপিসির) গাজায় দুর্ভিক্ষের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে গাজায় গণহত্যার (জেনোসাইড) কথা স্বীকার করা হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে গণহত্যা বন্ধে ইসরায়েলকে বাধ্য করতে যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ফিলিস্তিনের পক্ষে নিয়মিত বিক্ষোভ হচ্ছিল।
দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ের জন্য স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার একমাত্র পথ।অ্যান্টনি আলবানিজ, প্রধানমন্ত্রী, অস্ট্রেলিয়া
এদিকে গতকাল পর্তুগালেরও স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ছিল। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এ ঘোষণা আসেনি। অন্যদিকে ফ্রান্স আজ সোমবার স্বীকৃতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। আরও কয়েকটি দেশ জাতিসংঘের অধিবেশন চলাকালে স্বীকৃতি দিতে পারে।
আজ ফ্রান্স স্বীকৃতি দিলে জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই শুধু বাকি থাকবে। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্য সফরে লন্ডনের ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে নিজের বিরোধিতা পুনর্ব্যক্ত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার স্বীকৃতির পর গতকাল মধ্যরাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ট্রাম্পের নতুন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এখন জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পথে চূড়ান্ত পর্যায়ে বাধা হয়ে থাকল যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদে ওয়াশিংটনের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। কোনো রাষ্ট্রের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে স্থায়ী পাঁচ দেশের কোনো দেশ ভেটো দিলে তা আর এগোয় না।