পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে মোমবাতি এবং মশাল হাতে কাশ্মীরের শিক্ষার্থীরা। পাঞ্জাবের চণ্ডীগড়ে, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫
পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে মোমবাতি এবং মশাল হাতে কাশ্মীরের শিক্ষার্থীরা। পাঞ্জাবের চণ্ডীগড়ে, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

পাকিস্তান-ভারতের উত্তেজনা কি কমাতে পারবে সৌদি আরব

ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ বন্দুক হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। পাকিস্তান তা নাকচ করেছে। দুই দেশ পাল্টাপাল্টি নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিবেশী বৈরী এই দুই দেশের সাবেক কর্মকর্তাসহ অনেকে উসকানিমূলক কথা বলছেন। এতে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সৌদি আরব দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে লিখেছেন পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ডনের সাবেক সম্পাদক আব্বাস নাসির। ২৭ এপ্রিল লেখাটি অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধকে এক হাজার বছরের পুরোনো বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি কি এটা রূপক অর্থ বলেছেন, না ইতিহাস নিয়ে তাঁর বিভ্রান্তি, তা স্পষ্ট নয়। তিনি মনে করেন, ভারত-পাকিস্তান নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারবে।

ট্রাম্পের ভাষায়, উভয় দেশের ‘সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সুরাহা করতে পারবে।’ শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত উড়োজাহাজ এয়ারফোর্স ওয়ানে এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প এ কথা বলেন।

২২ এপ্রিল ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগ পর্যটক। নয়াদিল্লির অভিযোগ, হামলার সঙ্গে ইসলামাবাদ জড়িত। ইসলামাবাদ তা নাকচ করে দিয়েছে। তবে এরই মধ্যে হামলার জেরে পাকিস্তানের সঙ্গে করা ৬৫ বছরের পুরোনো সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিতসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। জবাবে পাকিস্তানও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর পর থেকে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার ট্রাম্প ওই মন্তব্য করলেন।

ইসলামাবাদে অবস্থানকারী কিছু পশ্চিমা কূটনীতিকও ট্রাম্পের মতো একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপ-আলোচনায় তাঁরা এই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মনে করেন, পেহেলগামের ঘটনার পর এই ধরনের পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক প্রতিক্রিয়া যে হবে, তা বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু একটা সময় পর উত্তেজনা কমে যাবে এবং পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে।

পাকিস্তানের নাগরিকেরা ভারত ছাড়ছেন। পাহারায় এক ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মী। পাঞ্জাবের অমৃতসরের কাছে আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্তের চৌকিতে। ২৭ এপ্রিল ২০২৫

কিন্তু ভারতের মেজাজ একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে। অন্ততপক্ষে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে মনে হচ্ছে, দেশটির মনোভাব যুদ্ধংদেহী ও চরম জাতীয়তাবাদী। দেশটির কিছু অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাম্প্রতিক কথাবার্তা থেকে এমনটি আভাস পাওয়া গেছে। তাঁরা মনে করেন, [ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র] মোদি সরকার কেবল কূটনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েই থামবে না। তাঁর সরকার পাকিস্তানকে ‘শাস্তি’ দিতে নিশ্চিতভাবে ‘কিনেটিক’ বা সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করবে।

ভারতের মূলধারার একজন টিভি সঞ্চালক কয়েক দিন আগে দেশটির অবসরপ্রাপ্ত এক তিন-তারকা জেনারেলকে পেহেলগামের ঘটনা প্রসঙ্গে নানা প্রশ্ন করেন। টিভি সঞ্চালকের প্রশ্ন ছিল, পেহেলগাম হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন এমন কোনো পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার মেজর বা ব্রিগেডিয়ারকে কি ‘কিনেটিক’ অভিযানের মধ্যে হত্যা করা হতে পারে?

তখন কাশ্মীরে দায়িত্ব পালনকারী সেই তিন-তারকা জেনারেল বলেন, ‘শুধু ব্রিগেডিয়ার বা নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদেরই কেন নিশানা করা হবে?’ ভারতের এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে হামাস ও তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করেন। তাঁর পরামর্শ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও গাজার ওপর ইসরায়েলি অভিযানের মতো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

এমন তুলনা ছিল অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক ও উম্মত্ত মানসিকতার। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, এটি কি কেবল একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তার কল্পনা, নাকি ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও মনোভাব একই? যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচালনায় রয়েছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি।

ভারতের সামাজিক ও প্রচলিত গণমাধ্যম যদি জনমতের প্রতিফলন হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয়, বহু ভারতীয় বিশ্লেষক, সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তি গণহত্যার শিকার গাজাবাসীর প্রতি সামান্যতম সহানুভূতিও দেখাননি। বরং তাঁরা বারবার ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর প্রশংসা করছেন ও ঈর্ষা প্রকাশ করেছেন এবং প্রকাশ্যে জানতে চেয়েছেন, কেন ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে না।

ভারতে সবাই হিতাহিত বিবেচনাশূন্য হয়ে পড়েছেন, আমি তা বলছি না। সেখানে শুভবুদ্ধির কিছু কণ্ঠস্বরও রয়েছে, তবে তা বিচ্ছিন্ন। তাই বদ্ধ উন্মাদদের চিৎকারের ভিড়ে তাঁরা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন। তবুও তাঁরা দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে পরিস্থিতি সশস্ত্র সংঘাতের দিকে গেলে কেমন ভয়াবহ হতে পারে, তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

আব্বাস নাসির

পারমাণবিক প্রতিরোধের মূল গুরুত্ব হলো প্রচলিত যুদ্ধ (কনভেনশনাল ওয়ার) ঠেকানো। বিশেষ করে দুই অসম শক্তির প্রতিপক্ষ যাতে যুদ্ধে না জড়ায়, সেটা নিশ্চিত করাই পারমাণবিক প্রতিরোধের মূল কথা। তাই, আমার মনে হয় কেবল মানসিকভাবে বিকৃত মানুষই পরিস্থিতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইবে, যা শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষকে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।

হ্যাঁ, বিশেষজ্ঞরা এখন দ্বিতীয়বার হামলা চালানোর সক্ষমতা (সেকেন্ড স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি) নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন। কোন পক্ষের সেই সক্ষমতা আছে এবং কোন পক্ষের নেই, তা নিয়ে তাঁরা হয়তো তর্ক করবেন। (দ্বিতীয়বার হামলা চালানোর সক্ষমতা বলতে বোঝায়, কোনো দেশ পারমাণবিক হামলার শিকার হওয়ার পর, হামলাকারী দেশকে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে পাল্টা হামলা চালানোর সক্ষমতা।) কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, এসব আলোচনা মানবজাতিকে সম্ভাব্য নজিরবিহীন হুমকি থেকে রক্ষা করতে পারে না। যে হুমকি দুই দেশের দেড় শ কোটি মানুষ, আরও বিস্তৃতভাবে বললে পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে হুমকিতে ফেলছে।

মোদি সরকার এই বিষয়টি প্রায় সময় প্রমাণ করেছে, নিজ দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমের ওপর তাদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং কোটি কোটি অনুসারীসহ অনেকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যা তাদের বক্তব্যকে জোরালোভাবে ছড়িয়ে দেয়। তাই মোদি সরকার যদি চায় প্রচলিত ও সামাজিকমাধ্যমের দ্বারা ‘গুপ্তহত্যাসহ কিনেটিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার’ বিষয়টি যেমন ভাবা, তেমন হওয়ার পর্যায়ে না পৌঁছালেও তাঁরা জনগণকে কিছু উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আবেগতাড়িত করে থাকবেন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ পেহেলগামের ঘটনার ‘নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের’ প্রস্তাব করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের তরফে করা অভিযোগগুলো যাচাই করা যাবে। তারা যেসব অভিযোগ করেছে, তা বৈধ বা বিশ্বাসযোগ্য না হলে বাতিল করে দেওয়া যাবে।

ভারতের কিছু শান্তিকামী মানুষ মনে করেন, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের দেওয়া তদন্তের প্রস্তাব খুব বেশি গুরুত্ব পাবে না। কারণ, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার তদন্তের কাজ পাকিস্তান যথাযথভাবে শেষ করেনি। ওই হামলায় অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা অন্তত ১৭৫ জনকে হত্যা করেছিলেন। আহত হয়েছিলেন প্রায় ৩০০ জন। পাকিস্তান এই হামলার তদন্ত যথাযথভাবে শেষ করলে এখন ভিন্ন কিছু হলেও হতে পারত।

পেহেলগামে হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে

সম্ভবত এটি একটি ভালো যুক্তি। তবে ওই ঘটনার পর থেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে পাকিস্তান। বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, মানি লন্ডারিং ইত্যাদি বিষয়ে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) বিধিনিষেধ মেনে চলেছে। এর পর থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসী নেতাকে আটক ও কারাবন্দী করা হয়েছে। তা ছাড়া পর্যবেক্ষকেরা অন্তত দুই থেকে তিনটি ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বা ছদ্মবেশী অভিযানের কথা উল্লেখ করেছেন, যার সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছে, এসব দাবি মিথ্যা।

এমন একসময়ে পেহেলগামের হত্যাকাণ্ড ঘটল, যখন পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্ব অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীলতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। এই ঘটনা পাকিস্তানের অগ্রাধিকারের লক্ষ্যকে পুরোপুরি ব্যাহত করবে। এ ধরনের কোনো ঘটনার ফলাফল ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের জন্য বেশি ক্ষতিকর।

আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলে সাধারণ বিচারবুদ্ধি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত স্পর্শকাতর। পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংলাপের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব আশাবাদী।

কাশ্মীরের পেহেলগামের মারহামা গ্রামে সন্দেহভাজন জঙ্গি হামলার পর টহল দিচ্ছেন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য। দক্ষিণ কাশ্মীরের পেহেলগামের দিকে যাওয়ার একটি মহাসড়কে, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে উদ্ভূত সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী দেখিয়েছে সৌদি আরব ও ইরান। এই উদ্যোগ আশার আলো দেখাচ্ছে। আমাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো উচিত। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ সফর করেছেন। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। তবে আলোচনার বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।