প্রবাসীদের বসবাসের জন্য সবচেয়ে ভালো ১০ দেশ

অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে প্রবাসে জীবনযাপন করছেন। ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ এখন প্রবাসী।

উন্নত জীবনের আশায় মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে ভিনদেশে বসবাসের জন্য চলে যাচ্ছে। ভিনদেশে যেমন বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তেমন অনেক চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হয়। বিদেশে প্রবাসীদের সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র অবশ্যই অর্থ। কয়েকটি জরিপ অন্তত সে কথাই বলছে।

তবে অর্থের পাশাপাশি জীবনযাপন মান এবং স্থায়ী হওয়ার সুযোগ-সুবিধাও প্রবাসীদের সুখী করতে বড় ভূমিকা রাখে। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ‘ইন্টারনেশনস’ পাঁচটি সূচককে (সামগ্রিক সুখ বা সন্তুষ্টি, ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনা, নতুন দেশে সহজে স্থায়ী হওয়ার সুবিধা, কর্মসংস্থান ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এবং জীবনমান) মূল ভিত্তি ধরে এ বছর (২০২৫) প্রবাসীদের বসবাসের জন্য সবচেয়ে ভালো ১০ দেশের একটি তালিকা করেছে। এ তালিকা নিয়ে আজকের আয়োজন।

পানামা

পানামার রাজধানী পানামা সিটি

৪৬ দেশ নিয়ে করা এ তালিকায় ১ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে মধ্য আমেরিকার দেশ পানামা। যে পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে জরিপ পরিচালিত হয়েছে তার তিনটিতেই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে পানামা। এ তিন সূচক হলো কর্মসংস্থান, বাসস্থান ও ডিজিটালসহ প্রয়োজনীয় সুবিধার সহজলভ্যতা, জীবনযাত্রার মান এবং ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনা।

এসব কারণে ফ্রিল্যান্সার, যাঁরা অনলাইনভিত্তিক কাজ করেন, অবসরভোগীসহ যাঁরা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন এবং ঘরের বাইরে নানা কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকতে পছন্দ করেন, তাঁদের কাছে পানামা খুব জনপ্রিয়।

পানামায় একটি রিসোর্টের মালিক ও পরিচালক ক্যারি ম্যাকি বলেন, ‘আমি এমন ঘন জঙ্গলে ভরা ভূপ্রকৃতি খুব পছন্দ করি। এখানে অনেক পশু-পাখির দেখা পাওয়া যায়। আমাদের রিসোর্টটি এতটাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে এখানে সৈকতে আমাদের অতিথি ছাড়া অন্য কাউকে খুব একটি দেখা যায় না। এখানে কখনো ভিড় জমে না এবং পরিবেশ সব সময়ই আনন্দময় থাকে।’

কলম্বিয়া

কলম্বিয়ার বোগোটায় একটি ফলবাজার। জীবনযাপন ব্যয় অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় প্রবাসীরা বসবাসের জন্য দেশটিকে বেছে নেন

তালিকায় ২ নম্বরে আছে কলম্বিয়া। দেশটি ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনা ও দেশে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ-সুবিধার সূচকে এগিয়ে। জীবনযাপন ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়াও কলম্বিয়ায় প্রবাসীদের সুখে থাকার একটি বড় কারণ।

কলম্বিয়ায় থাকা প্রবাসীরা নিজেদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে খুশি। এ সন্তুষ্টির কারণে দেশটির ৮০ শতাংশ প্রবাসী মনে করেন, কলম্বিয়া তাদের স্বাগত জানায় এবং দেশটিতে তাঁরা নিজেদের ঘরে থাকার অনুভূতি পান।

যুক্তরাজ্য থেকে ১০ বছর আগে কলম্বিয়ায় চলে আসা পরশিয়া হার্ট বলেন, ‘কলম্বিয়ার মানুষ আন্তরিক, অতিথিপরায়ণ ও কৌতূহলী। প্রতিবেশী ও বন্ধু হিসেবে তাঁরা চমৎকার।’
কলম্বিয়ায় ছোট একটি হোটেল চালান পরশিয়া হার্ট। তিনি আরও বলেন, এখানকার জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলো পরিবারকেন্দ্রিক। তাই আমার সেরা পরামর্শ হলো একটি বড় ও উচ্ছ্বল কলম্বিয়ান পরিবার খুঁজে নিয়ে নিজেকে তাদের অংশ করে তুলুন। নিজের গা থেকে প্রবাসী লেবেল যত দ্রুত ঝেড়ে ফেলতে পারবেন, মানিয়ে নেওয়াও তত সহজ হবে।

মেক্সিকো

মেক্সিকোর একটি সৈকত

তালিকায় ৩ নম্বরে থাকা মেক্সিকোর সংস্কৃতি দারুণ। এখানে প্রবাসীদের স্বাগত জানানোর হার বৈশ্বিক হারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলাও বেশ সহজ।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকো চলে গেছেন ডেভিড বি রাইট। তিনি সেখানে একটি বিপণন সংস্থার মালিক। ডেভিড বলেন, ‘লোকজন, সংস্কৃতি, খাবারদাবার, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাশ্রয়ী জীবনযাপন ব্যয়, স্বাস্থ্যসেবা—সবকিছু মিলিয়ে বসবাসের জন্য এটি দারুণ দেশ। আমি যে কাজ করি, সেটি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে করা যায়। তবে কেন আমি স্বর্গে বসবাস করব না?’

থাইল্যান্ড

প্রবাসীদের থাইল্যান্ডের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন থাকাটা জরুরি। বিশেষ করে দেশটির রাজপরিবারের বিষয়ে

সামগ্রিকভাবে সুখী অনুভব করা ও ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনায় ভালো করায় তালিকায় ৪ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে থাইল্যান্ড। প্রবাসীরা এখানে নতুন জীবনে সহজে মানিয়ে নিতে পারেন। স্থানীয় লোকজন প্রবাসীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করেন।
ইউরোপ থেকে এক বছর আগে থাইল্যান্ডে চলে এসেছেন নাতাশা এলড্রেড। ফুকেটে তাঁর ব্যবসা। এই নারী বলেন, ‘আর কোনো দেশ (বিদেশিদের) এতটা স্বাগত জানায় কি না, আমার জানা নেই। আমি ভ্রমণের জন্য এত সুন্দর দেশ দেখিনি। আর কোথাও এতটা নিরাপদবোধ করিনি।’

হাসপাতাল, স্কুল, দোকান আর বিমানবন্দর মিলিয়ে ফুকেটে নাগরিক সব অবকাঠামো রয়েছে। একই সঙ্গে এখানে আপনি চাইলে জঙ্গলে ভ্রমণে যেতে পারবেন। এখানকার নিরিবিলি সৈকতগুলো উপভোগ করতে পারবেন। এসবের সহজলভ্যতা এটিকে বসবাসের জন্য একটি আদর্শ শহর করে তুলেছে।

থাইল্যান্ডে ইংরেজি বহুল প্রচলিত। তবে প্রবাসীদের থাইল্যান্ডের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা থাকা জরুরি।

ভিয়েতনাম

ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরের একটি দৃশ্য

ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনার সূচকে প্রথম ও সামগ্রিক সুখ সূচকে অষ্টম স্থান অর্জন করা ভিয়েতনাম তালিকায় ৫ নম্বরে। বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনাম।

ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়েক বছর আগে বসবাসের জন্য ভিয়েতনাম চলে যান বারথা পেসিক। তিনি বলেন, ‘এখানে জীবন দ্রুত এগোচ্ছে, চারপাশে অসংখ্য উন্নয়নকাজ হচ্ছে এবং স্থানীয় লোকজন খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ও পরোপকারী।’

বারথা বিশেষ করে ভিয়েতনামের খাবারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনামের কফি অবশ্যই চেখে দেখার মতো। এটি খুব কড়া আর নোনতা। কফির অনন্য এ ধরনটি আমি রীতিমতো ভালোবাসি।’

চীন

বিদেশি শিক্ষার্থী, প্রযুক্তি পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীরা বসবাসের জন্য চীনকে বেছে নিচ্ছেন

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। দ্রুত নগরায়ণের কারণে দেশটির সাংহাই, বেইজিং ও শেনজেনের মতো শহরগুলোতে আধুনিক অবকাঠামো, হাসপাতাল, আন্তর্জাতিক মানের স্কুল এবং উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এসবের সহজলভ্যতা শহরগুলোতে প্রবাসীদের জন্য স্থায়ী হওয়া সহজ করে দিয়েছে। সামগ্রিক সুখ, প্রবাসীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা ও নতুন দেশে সহজে স্থায়ী হওয়ার সূচকে ১০ এর মধ্যে ৭ পেয়েছে চীন।

প্রবাসীরা বলেছেন, চীনে কর্মসংস্থান, জীবনযাত্রার মান এবং স্থায়ীভাবে মানিয়ে নেওয়ার ভালো সুযোগ থাকায় বিশেষ করে বিদেশি শিক্ষার্থী, প্রযুক্তি পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীরা বসবাসের জন্য দেশটিকে বেছে নিচ্ছেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাত

প্রবাসীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে উচ্চ বেতন ও করমুক্ত আয়ের সুবিধা উপভোগ করেন

সংযুক্ত আরব আমিরাত তালিকায় সপ্তম স্থানে আছে। দুবাই ও আবুধাবি প্রবাসীদের জন্য বিশ্বমানের অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে। পাশাপাশি রয়েছে নিরাপদ পরিবেশ। প্রবাসীরা এখানে উচ্চ বেতন, করমুক্ত আয় ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির প্রশংসা করেন।

সামগ্রিক সুখ ও প্রবাসীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার সূচকে ১০ এ ৮ পেয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সহজ যাতায়াত, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও বৈচিত্র্যময় জীবনধারা পেশাজীবীদের পরিবারসহ দেশটিতে বসবাসের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

ইন্দোনেশিয়া

বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিমঅধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া। দেশটির প্রাণবন্ত সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাশ্রয়ী জীবনযাপন উপভোগ করেন প্রবাসীরা

ইন্দোনেশিয়ার প্রাণবন্ত সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাশ্রয়ী জীবনযাপন উপভোগ করেন প্রবাসীরা। স্থানীয় মানুষ বন্ধুবৎসল।

ইন্দোনেশিয়ায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো। অনেক প্রবাসী দেশটির খাবারের প্রশংসা করেন। বাণিজ্যিক ও পর্যটন এলাকাগুলোতে ইংরেজি প্রচলিত।

স্পেন

প্রবাসীরা স্পেনের খাবার, সৈকত, উৎসব ও মনোরম আবহাওয়া উপভোগ করেন

তালিকায় নবম স্থানে থাকা স্পেনে জীবনযাত্রা খানিকটা ধীরগতির। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন না কাটিয়ে এখানে মানুষ জীবনকে ধীরস্থিরভাবে উপভোগ করেন। লোকজন আন্তরিক স্বভাবের এবং সমাজব্যবস্থা শক্তিশালী পরিবারকেন্দ্রিক।
পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় জীবনযাপন ব্যয় তুলনামূলক কম স্পেনে। অথচ দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবার মান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। প্রবাসীরা এখানকার খাবার, সৈকত, উৎসব ও মনোরম আবহাওয়া উপভোগ করেন। তবে সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হতে স্প্যানিশ ভাষা শিখতে হয়।

মালয়েশিয়া

প্রবাসীরা মালয়েশিয়ার বহু সংস্কৃতির পরিবেশকে পছন্দ করেন

দশম স্থানে রয়েছে এশিয়ার আরেক দেশ মালয়েশিয়া। কুয়ালালামপুর, পেনাং ও লংকাউয়ির মতো শহরগুলোতে আধুনিক অবকাঠামো, হাসপাতাল, স্কুল রয়েছে। এ শহরগুলোতে অনেক প্রবাসী বসবাস করেন।

প্রবাসীরা মালয়েশিয়ার বহু সংস্কৃতির পরিবেশ, স্থানীয় খাবার ও তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী জীবনযাপনের প্রশংসা করেন। নিরাপত্তা, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেশাজীবীদের পরিবারসহ দেশটিতে বসবাসে উৎসাহিত করে। অবসরভোগীদের মধ্যে যাঁরা অন্য দেশে গিয়ে অবসরজীবন উপভোগ করতে চান, তাঁদের জন্য মালয়েশিয়া আকর্ষণীয়।