প্রচণ্ড গরমে কাজ মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে মানুষের

  • প্রচণ্ড গরমে শ্রমজীবী মানুষের হিট স্ট্রোক, কিডনির রোগ,  হৃদ্‌রোগ, ফুসফুসের রোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।

  • বিশ্বে কৃষিশ্রমিক আছেন প্রায় ১০০ কোটি। নির্মাণসহ অন্যান্য খাতে কোটি কোটি শ্রমিক খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন।

প্রচণ্ড রোদে কৃষকেরা ছাতা মাথায় খেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী দিন দিন আরও উষ্ণ হচ্ছে। বসন্তকালেও তাপমাত্রা ছাড়াচ্ছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ডেকে আনছে দাবদাহ। প্রচণ্ড গরমে কাজ করার কারণে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের মৃত্যু ও শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। সম্প্রতি এ তথ্য উঠে এল কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে।

সম্মেলনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার শ্রমিক দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ও প্রচণ্ড গরমের কারণে অন্যান্য অসুস্থতায় প্রাণ হারাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে শ্রমিকদের মৃত্যু ঠেকাতে দেশগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শ্রমজীবী মানুষের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা ছিল সম্মেলনের মূল আলোচ্য। ‘অকুপেশনাল হিট স্ট্রেস’ বা ‘গরমে পেশাজীবীদের ঝুঁকি’ শীর্ষক এ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আরব অঞ্চলের প্রধান রুবা জারাদাত বলেন, ‘বিজ্ঞান আমাদের বলছে, এই বিষয়ে দেশগুলো আরও বেশি কিছু করতে পারে।’

প্রচণ্ড গরমে খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে হয় এমন শ্রমিক বা কর্মীদের জন্য আন্তর্জাতিক কোনো মানও ঠিক করা হয়নি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বিশ্ব যেভাবে উষ্ণ হচ্ছে, তাতে এ বিষয়ে নতুন পদক্ষেপ প্রয়োজন।

প্রাণঘাতী একটি দাবদাহের পর ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ নিয়ে নতুন নিয়ম করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হোয়াইট হাউস বলেছিল, ‘দেশের প্রধান আবহাওয়া-সম্পর্কিত ঘাতক গরম।’ তবে প্রতিশ্রুত সেই পদক্ষেপ এখনো নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।

চা–বাগানে নতুন পাতা কম থাকায় শ্রমিকেরা তপ্ত রোদে ঘুরে ঘুরে চা–পাতা তুলছেন

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি দাবদাহে নাজেহাল হয়েছিল ইউরোপের জনজীবন। তবে শুধু সাইপ্রাস ছাড়া ইউরোপের কোনো দেশ এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শ্রমজীবী মানুষদের প্রচণ্ড গরম থেকে রক্ষায় কাজের সময় বেঁধে দিয়েছিল দেশটি। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় কাজ করার সময় বেশি বিশ্রাম ও সুরক্ষামূলক পোশাকবিধি তৈরি করে।

গবেষকেরা বলছেন, প্রচণ্ড গরম বেশ কটি রোগের কারণ। প্রচণ্ড গরমে শ্রমজীবী মানুষের হিট স্ট্রোক, কিডনির রোগ,  হৃদ্‌রোগ, ফুসফুসের রোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। প্রচণ্ড গরমে কাজ করায় এসব রোগে শ্রমিকদের প্রাণহানি বাড়ছে।

গবেষকেরা বলছেন, প্রচণ্ড গরম বেশ কটি রোগের কারণ। প্রচণ্ড গরমে শ্রমজীবী মানুষের হিট স্ট্রোক, কিডনির রোগ,  হৃদ্‌রোগ, ফুসফুসের রোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। প্রচণ্ড গরমে কাজ করায় এসব রোগে শ্রমিকদের প্রাণহানি বাড়ছে।

প্রচণ্ড গরমে মৃত্যু ও রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে নির্মাণশ্রমিকেরা

মধ্য আমেরিকায় চিনিকলশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছে ‘লা ইজলা নেটওয়ার্ক’ নামে পেশাজীবীদের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন। এর প্রধান জাস্টিন গ্লেসার বলেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে মধ্য আমেরিকায় ২০ হাজারের বেশি চিনিকলশ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এক দশকে। আর কিডনি রোগে শ্রীলঙ্কায় মারা গেছেন প্রায় ২৫ হাজার।  

‘মানুষ মারা যাচ্ছে’

বিশ্বে কৃষিশ্রমিক আছেন প্রায় ১০০ কোটি। এ ছাড়া নির্মাণসহ অন্যান্য খাতে কোটি কোটি শ্রমিক খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন। মূলত এসব শ্রমজীবী মানুষ দাবদাহের বেশি ঝুঁকিতে আছেন বলে জানানো হয় সম্মেলনে। এ ছাড়া বাগান, ডাক বিভাগ, খাবার ও পণ্য সরবরাহের কাজে নিয়োজিত পেশাজীবী আর শ্রমিকেরাও সমান ঝুঁকিতে বলা জানানো হয়।

২০২০ সালে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন তাইওয়ানের একদল গবেষক। তাতে বলা হয়, প্রচণ্ড গরম ও দাবদাহ থেকে সৃষ্ট কিডনি রোগ হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে উষ্ণতা বৃদ্ধিতে উদ্ভূত ‘প্রথম মহামারি’।

আইএলওর পূর্বাভাস অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। আগামী বছরগুলোয় এ কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগবে দক্ষিণ এশিয়া ও সাবসাহারা আফ্রিকার দেশগুলো। ভারত, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর বহু মানুষ কৃষিজীবী। কোনো বিমাসুবিধা ছাড়াই সেখানের সিংহভাগ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।

পেশাজীবী মানুষের স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করেন বিদ্যা ভেনুগোপাল। চেন্নাইয়ের শ্রী রামচন্দ্র ইনস্টিটিউটের এই অধ্যাপক বলছেন, ভারতে মরুভূমির মতো আবহাওয়ায় কাজ করেন লাখ লাখ লবণশ্রমিক। এসব শ্রমিকের কিডনি ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাঁদের কোনো বিমাসুবিধা নেই। দিনমান তাঁরা লবণখেতে কাজ করেন। গ্রীষ্মকালে এই লবণশ্রমিকদের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রচণ্ড গরমের কারণে সৃষ্ট কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

ভূগর্ভস্থ কেব্‌ল স্থাপন প্রকল্পে কাজ করছেন শ্রমিকেরা

ভারতের উত্তরাঞ্চলের কোটি কোটি শ্রমিক ঝুঁকিতে আছেন জানিয়ে ভেনুগোপাল বলেন, বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কখন কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার অপেক্ষা করার মতো সময় নেই ভারত ও অন্য দরিদ্র দেশগুলোর। তিনি বলছেন, ‘মানুষ মারা যাচ্ছে, রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যরা এ থেকে বাঁচতে যা যা করে, আমাদেরও সেসব করা শুরু করতে হবে।’