
মায়ামি নামের মধ্যেই কেমন যেন একটা রোমান্টিক আবেশ মাখানো রয়েছে। গত শতাব্দীর আশির না নব্বইয়ের দশকের তরুণ বা যুবা বয়সের অনেকেই ইংরেজি টিভি সিরিয়াল ‘বে ওয়াচ’ দেখতেন আগ্রহ নিয়ে। ‘বে ওয়াচ’ শব্দটির কথা মনে না থাকলেও মায়ামির কথা অনেকে ভোলেননি। ফেসবুকে এমন প্রকাশ আমার ছবিতেই পেয়েছি। মায়ামি বিচটা যে মূলত রোমান্সের প্রতীক তা সবারই জানা। সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়মেই রোমান্স সবাই ভালোবাসেন। কেউ তার বহিঃপ্রকাশ ঘটান কেউ করেন কেউ বা রাখেন গোপন। আর এই বিদেশিদের কাছে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো গোপন বলে কিছু নেই। অতি আবেগে প্রিয় মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতে বা চুমু খেতে তাঁরা দ্বিধাবোধ করেন না। যেন এটাই স্বাভাবিক, নির্মল কোনো অনুভূতি। আমাদের বাঙালি দৃষ্টিতে যে তির্যক বিক্রিয়া ঘটে এ ব্যাপারে তাঁরা কিছুই জানেন না। এখানে তাঁরা একেবারেই যেন শিশুর মতো।
যাই হোক রোমান্সের প্রতীকী শহর এই মায়ামির রোমান্টিসিজম নিয়ে লেখার আগে আমি মায়ামি নিয়ে কিছু বলতে চাই। এর ইতিহাস বেশ সুন্দর, যদিও সবটা লেখা এখানে সম্ভব নয়। ছোট্ট করে বলছি। মায়ামি এবং মায়ামি বিচ—এ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন শহর। আমেরিকার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ফ্লোরিডা স্টেটসের অঙ্গ শহর মায়ামি। মায়ামি নদীর নামেই এ শহরের নামকরণ করা হয়। আমার দেখেশুনে মনে হয়েছে এর নাম মায়ামি নয় মায়াবী হলেই ভালো হতো। তবে এক মায়াবী রমণী জুলিয়া ডি ফরেস্ট টাটল সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী মহিলা। মায়ামি ফ্লোরিডার জমির প্রথম মালকিন তিনিই। আর সে জন্য তাঁকে বলা হয় ‘মাদার অব মায়ামি’ এবং তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি বৃহৎ আমেরিকান কোনো শহরের উদ্ভাবন করেন।
মায়ামি বিচ হচ্ছে দক্ষিণ ফ্লোরিডার একটি আইসল্যান্ড শহর। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের সবুজাভ জলঘেরা তীরই মায়ামি বিচ। দুটো শহরকে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করেছে একদিকে মায়ামি নদীর ওপর তৈরি হওয়া কলিন্স ব্রিজ আর অন্য দিকে খালের ওপরে তৈরি হওয়া ইন্ডিয়ান ক্রিকব্রিজ। বিশাল জলাশয়ের দুপাশে গড়ে উঠেছে অপূর্ব সুন্দর শহর, যেন সাজানো গোছানো ভিডিও গেমের কোনো শহর। একের পর এক উঁচু দালান, তাদের দাঁড়িয়ে থাকায় যেন কোনো রিদম আছে। স্বচ্ছ কাচে ঘেরা দালানগুলো, তার প্রতিচ্ছবি জলে পড়ে এক মুগ্ধতা তৈরি করে, সেটাও যেন দেখার কোনো বিষয়। আর খাল মানেই কোনো এলোপাতাড়ি কিছু নয়। দুপাশ যেন শান বাঁধানো ঘাট। জলের নীরব বয়ে চলার ঝলক যেন কোনো রমণীর গলার হার। মাঝে মাঝে সাদা প্রাইভেট বোট, রিভার ক্রুজগুলো সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়। আগন্তুকের ফেরারি মন প্রইনহড বেগে চলছে ফেরারি গাড়ি নিয়ে কিন্তু কোথাও কোনো শব্দ নেই। এমন মুগ্ধতায় ঘেরা মায়ামি বিচ সিটি। পর্যটকদের জন্য রয়েছে বিচের দুটো অংশ। উত্তর এবং দক্ষিণ মায়ামি বিচ। সাউথ বিচটাই মূলত বিখ্যাত এবং আকর্ষণীয়। এখানে যেমন জমে ওঠে বিলাসী পর্যটকদের আনাগোনা, তেমন পৃথিবীর সব বিখ্যাত সেলিব্রেটির অবসরযাপন থেকে শুরু করে চলে মনোহর সিনেমা জগতের নির্মাণকাজ।
আসল কথা কর্ম ব্যস্ত জীবনে এই অবসরটাই হলো বড় কথা। অবসর কাটাতেই মূলত সবার এখানে আসা। আমি যা দেখলাম এখানে বয়সের কোনো নির্দিষ্ট মাপ নেই। যার প্রথম যৌবন গিয়েছে চলে জীবনযুদ্ধে আর কাজে কাজে তিনিও যেন এই শেষ বয়সে হয়ে উঠেছেন সাগরপারের কোনো হংসমিথুন জুটি। চিত্রি পড়া, ভাঁজ হয়ে পড়া চামড়ার হাতও পরম মমতায় তেমনি এক হাতে রাখা। যেন সারা জীবনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতেই আসা। এ জন্য বলি রোমান্টিক হওয়ার জন্য বয়স কোনো ব্যাপার নয়। রোমান্স মানেই শুধু অন্তরঙ্গতা নয়। এক সঙ্গে পাশাপাশি বসে জ্যোৎস্নার আলো দেখায়ও হয়তো রোমান্স আছে।
যার কেউ নেই তার জন্য রোগে শোকে দায়িত্ব পালন করার মতোও কেউ থাকে না। আর রোমান্স! সে তো অনেক দূরের বিষয়। তারপরও আমি সাহস করে বেরিয়ে পড়ি অন্যের চোখে নিজেকে দেখব বলে। মনে হয় নাইবা হাত বাড়িয়ে বলল কেউ, ‘চলো তোমাকে নিয়ে যাব আজ সমুদ্রের নীল জলে’। আমি নিজেই তাই দেখি হৃদয়ের হাহাকার ঢেউ হয়ে নিঃস্ব তীরের বুকে ঝড়ে পড়তে। শামুকের সব খোলসে যেমন মুক্তো হয় না তেমনি সব জীবনও পূর্ণতা পায় না। জীবনের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন আমাকে স্পর্শ করেনি তেমনি করেনি অনেক সুন্দর মূহর্তও। মনের মধ্যে সদাই একজন বাস করে সে সত্যি স্বপ্নের মতো। আমি যেখানেই যাই সে সেখানেই যায়। মনে হয়,
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।’