
সিলেট মেডিকেল কলেজে আমাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। শিক্ষাজীবন শেষ হয় ১৯৮০ সালে। তারপর কাজের সুবাদে বন্ধুরা এখানে-সেখানে ছড়িয়ে পড়ি। এখনো আমাদের অনেকেই নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত আছি। কেউ কেউ অবসরযাপন করছেন। কিছু বন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই; পাড়ি দিয়েছেন অচিনপুরিতে।
মেডিকেল কলেজে আমরা ছিলাম ১২তম ব্যাচ। বিশাল আয়োজন করে আমাদের ব্যাচের পুনর্মিলনী প্রথম করা হয় সিলেট শহরে। এবারে দ্বিতীয় পুনর্মিলনের স্থান নির্ধারণ করা হয় কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ। দারুচিনি দ্বীপ। আমরা বন্ধুরা বাংলাদেশ বিমানে করে এ বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি রওনা হই কক্সবাজারের উদ্দেশে। ঢাকা অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে সবাই এসে পৌঁছালে একটা আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বিরাট হইচই, কোলাহল একে-অন্যকে আলিঙ্গন করে বিমানবন্দরের বিশ্রাম এলাকা প্রকম্পিত করে তোলে সবাই। বন্ধুদের অনেকের সঙ্গে হয়তো মেডিকেল কলেজ ত্যাগে পর এই প্রথম দেখা। এ মিলনে আমরা সকলেই উদ্বেলিত ও উদ্ভাসিত।
পুনর্মিলনী উদ্যাপন আমাদের করে তুলল উৎসবমুখর। আধ ঘণ্টার একটু বেশি সময়ের মধ্যে উড়োজাহাজ অবতরণ করল কক্সবাজার বিমানবন্দরে। সেখান থেকে মাইক্রোবাসে চেপে চলে এলাম নির্ধারিত হোটেলে। রাতটা সেখানেই কাটল। পরদিন সকালে রওনা হলাম টেকনাফের উদ্দেশে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফে যাওয়ার পথটি ছিল অসাধারণ। দু পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাগরে ভাসমান বিচিত্র রঙের সাম্পান এক অদ্ভুত নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করল। এ ধরনের নৌকার চল শুধু এ অঞ্চলেই রয়েছে। টেকনাফে যাওয়ার পথে সাগরে ভাসমান কারুকার্যখচিত সাম্পানগুলো রীতিমতো মন কেড়ে নিল।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা টেকনাফ পৌঁছে যাই। টেকনাফ থেকে কেয়ারি জাহাজে যাত্রা করি দারুচিনি দ্বীপের উদ্দেশে। পুরো জাহাজে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। জাহাজের ওপরতলার ডেকে আমরা ৭৫ জন বন্ধু-বান্ধবী। হই-চই, আর আড্ডা। স্মৃতিচারণই মুখ্য। দিগন্তজুড়ে বঙ্গোপসাগর আমাদের সংগত করে। অনিশ্চিত ফেনিল ঢেউ ভেদ করে আমরা দারুচিনি দ্বীপের দিকে যেতে থাকি। মাথার ওপর উজ্জ্বল আকাশ। নাফ পার হই যখন, তখন ওপারে দাঁড়িয়ে মিয়ানমার; আমরা আলোচনায় ডুবে যাই। নানা বিষয় উঠে আসে কথায় কথায়। কী ভালো যে লাগল!
অবশেষে দারুচিনি দ্বীপের দেশে। প্রায় ২৫০ বছর আগে আরব ব্যবসায়ীরা প্রথম এ দ্বীপে আসেন। তাঁরা দ্বীপটির নাম দেন জিঞ্জিরা। পরবর্তী সময়ে পর্তুগিজ জলদস্যুরা দ্বীপটির নাম রাখে সিনামন আইল্যান্ড, বাংলায় দারুচিনি দ্বীপ। ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রামের ডিসি মি. মার্টিনের নামে নামকরণ হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে স্থানীয় অধিবাসীদের আগমন ঘটে বহু বছর আগে। টেকনাফ থেকে কিছুসংখ্যক জেলে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে এসে দ্বীপটির সন্ধান পায়। পরে তারা সেখানে স্থায়ী বসতি গড়ে। শুরুতে সাতটি পরিবার আসে বলে জানা যায়। পরে এসব পরিবারের সূত্রেই আসতে থাকে আরও লোক। বর্তমানে দ্বীপটিতে প্রায় ৬ হাজার লোকের বাস।
পুরা দ্বীপে নয়টি গ্রাম রয়েছে। একটাই ইউনিয়ন। মানুষ সাধারণ নিরীহ প্রকৃতির। নেই কোনো বিশৃঙ্খলা। পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি এখানকার মানুষের অগ্রাধিকার বিষয়। তাই যে কেউ অবাধে যেকোনো সময় ঘুরতে পারে সাগরপারে। জীবিকা বলতে মাছধরা, ধানচাষ, তরমুজ চাষ ও নারকেল। অসংখ্য নারকেল গাছবেষ্টিত এ দ্বীপ। অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসে অক্টোবর ও এপ্রিলে মধ্যে। এপ্রিলের পর বঙ্গোপসাগর তুলনামূলক উত্তাল থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কাও থাকে অনেক। তখন টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জাহাজ চলাচলও থাকে বন্ধ। এ কারণে পর্যটক থাকে তুলনামূলক কম।
পর্যটকদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেল। আমরা ছিলাম এরই একটিতে। সেখানে থাকা-খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। বিকেলে দ্বীপ ঘুরতে বের হই। যানবাহন বলতে রিকশা ভ্যান। তবে হাঁটতেই ভালো লাগে বেশি। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম হুমায়ুন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির সামনে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এখানে একটি ঘর তুলেছিলেন। মাঝেমধ্যে এখানে এসে থাকতেন তিনি। সেই বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। ঘুরতে ঘুরতেই চলে এল গোধূলি। সূর্যাস্তের ক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। আমরা দারুণ উত্তেজনায় সেই সূর্যাস্তের অপেক্ষায়।
পরদিন দুপুরে গেলাম সেন্টমার্টিনের কাছে আরেক ছোট দ্বীপ ছেঁড়া দ্বীপে। ট্রলারে চেপে গেলাম সেখানে। কোনো জনবসতি নেই এখানে। ভাটায় জাগে আর জোয়ারে হারিয়ে যায় বলে তা সম্ভবও নয়। এখানেই দেখা মিলল বহুবর্ণিল কোরালের।
মাত্র দুদিন। তবু কী উজ্জ্বল এ দারুচিনি দ্বীপের স্মৃতি। পরদিন বিকেলেই আমরা টেকনাফ হয়ে ফিরে আসি কক্সবাজারে। ভোলার মতো নয়, দুদিনের এ দারুচিনি দ্বীপ ও বন্ধুযোগ।