চিঠি দিও প্রতিদিন

গ্রেট ব্রিটেনের কাম্ব্রিয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীদের লেখা চিঠি। ছবি: সংগৃহীত
গ্রেট ব্রিটেনের কাম্ব্রিয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীদের লেখা চিঠি। ছবি: সংগৃহীত

কাউকে সর্বশেষ কবে হাতে লিখে চিঠি দিয়েছেন? আমার মনে পড়ে না। টেক্সট মেসেজ, ভিডিও কল, হোয়াটসঅ্যাপের যুগে এখন আর কেউ কাউকে হাতে চিঠি লিখে না। অথচ শত শত বছর ধরে এই চিঠি ছিল যোগাযোগের খুব প্রচলিত ও শক্তিশালী মাধ্যম।

আগে সাহিত্যিক ও রাজনীতিকদের অনেকেই খুব সুন্দর করে চিঠি লিখতে জানতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎ চন্দ্র, কাজী নজরুল ইসলাম, উইনস্টন চার্চিল, আব্রাহাম লিঙ্কন, মহাত্মা গান্ধী এঁরা সবাই চমৎকার পত্রলেখক ছিলেন।

রেকর্ডকৃত ইতিহাস অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ চিঠির লেখক হলেন নিউইয়র্কে ব্রুকলিনের একজন নারী ১৯৫২ সালে লেখা এই চিঠির প্রাপক ছিলেন তাঁর বন্ধু। তিনি সে সময় কোরিয়ায় যুদ্ধরত ইউএস আর্মির সদস্য ছিলেন। দীর্ঘ এই চিঠি লিখতে ওই নারীর এক মাস সময় লেগেছিল।

২০১৫ সালে হাতে লেখা দীর্ঘ চিঠির আগের রেকর্ড ভেঙে ফেলেন গ্রেট ব্রিটেনের কাম্ব্রিয়ার আটটি স্কুলের শিক্ষার্থী। ওই আটটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল তাদের আশপাশের সবচেয়ে ভালো লাগা বিষয় নিয়ে লিখতে। তাদের লিখতে বলা হয়েছে ‘অ্যাম্বাসেডর’ নামে মূল্যবান সাদা কাগজে (২৯০ মিটার লম্বা পেপার রোল)। তারা সানন্দে কাজটি করেছিল।

অন্যদিকে ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা সংক্ষিপ্ত চিঠির লেখক হলেন ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো। ১৮৬২ সালে হুগো তাঁর ‘লা মিজারেবল’ উপন্যাসটি প্রকাশ করে অবকাশ যাপনে যান। কিন্তু অবকাশ যাপনে থাকলেও হুগোর মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল উপন্যাসের বিক্রি নিয়ে। এই খবর জানতে তিনি ডাকে প্রকাশককে চিঠি দিলেন। প্রকাশক খাম খুলে দেখলেন, চিঠিতে কেবলই আঁকা আছে সাদা কাগজের ওপর বড় একটি প্রশ্নবোধক (?) চিহ্ন।

যেমন লেখক তেমনি রসিক ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশক। তিনি বুঝতে পারলেন চিঠির মাজেজা। উত্তর দিলেন কেবল একটি বিস্ময়সূচক (!) চিহ্ন এঁকে। বলা বাহুল্য, প্রকাশক হুগোকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, উপন্যাসটি পাঠক লুফে নিয়েছে। সত্যি খুব বিক্রি হয়েছিল বইটি।

বাংলা ভাষায় সংক্ষিপ্ত চিঠির অফিশিয়াল রেকর্ড আমার জানা নেই। তবে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক যায় যায় দিন এর ‘চিঠি’ সংখ্যায় কোনো একজন লেখক জানিয়েছিলেন, কানাই নামের এক বাঙালি ছাত্র বাবার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। ওই চিঠিতে লিখেছিল—

‘টাকা নাই, টাকা চাই

ইতি,

কানাই।’

বাবা চটপট উত্তর দিলেন—

‘কর মাপ

ইতি,

তোমার বাপ।’

চিঠি নিয়ে আরেকটি মজার গল্প আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিডওয়েস্টের কোনো এক ছোট শহরের হোটেল কর্তৃপক্ষকে এক ভদ্রলোক আগে থেকেই অনুমতি চেয়ে চিঠি দিলেন। তিনি হোটেলে থাকাকালীন সঙ্গী কুকুরকে রুমে রাখতে চান (সার্ভিস ডগ না হলে অনেক হোটেলে কাস্টমারের সঙ্গে পোষা প্রাণী রুমে রাখা বারণ)। চিঠিতে লেখা ছিল—

‘জনাব, আমার কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে চাই। সে খুব পরিপাটি এবং ভদ্র। আপনারা কি ওকে আমার সঙ্গে রাতে থাকার অনুমতি দেবেন?’

দ্রুত চিঠির উত্তর পেলেন ওই ভদ্রলোক। হোটেল কর্তৃপক্ষ লিখেছে—

‘মহাশয়,

বহু বছর ধরে আমি এই হোটেলটি চালাচ্ছি। এই দীর্ঘ সময়ে একবারও কোনো কুকুর আমার হোটেল থেকে তোয়ালে, বিছানার চাদর, থালাবাটি বা দেয়ালের ছবি চুরি করেনি। কোনো দিন কোনো কুকুরকে মাঝ রাতে আমাকে জোরপূর্বক বের করে দিতে হয়নি মাতলামি এবং অভদ্রতার জন্য। বিল না মিটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও কোনো কুকুর করেনি।

অতএব, আপনার কুকুরকে স্বাগতম জানাই আমার হোটেলে। আর সে যদি সাফাই গায় আপনার পক্ষে, তাহলে আপনিও স্বাগত আমার হোটেলে।’

অ্যান্ড্রু ক্যারোলের সংগৃহীত যুদ্ধের চিঠি। ছবি: সংগৃহীত

চিঠি নিয়ে এমন অনেক গল্প আছে। অ্যান্ড্রু ক্যারোল নামের একজন আমেরিকান ৩০ বছর ধরে সাবেক সৈনিকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করেছেন দেড় লাখের মতো হাতে লেখা চিঠি। চিঠির সময়কাল আমেরিকান সিভিল ওয়ার (১৮৬১-১৮৬৫), প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) থেকে কোরিয়ার যুদ্ধ (১৯৫০-১৯৫৩) এবং হালের ইরাক যুদ্ধ (২০০৩-২০১১) পর্যন্ত। সৈনিক ছেলের কাছে বাবা-মায়ের চিঠি, নবজাতকের জন্ম সংবাদে উৎফুল্ল সৈনিক বাবার চিঠি, হাজার মাইল দূরের প্রিয়তম স্বামীর কাছে বিচ্ছেদে ব্যাকুল স্ত্রীর চিঠি—এমনি হরেক রকম চিঠির সম্ভার। ক্যারোলের যুদ্ধের চিঠি সংগ্রহশালার নাম হচ্ছে সেন্টার ফর আমেরিকান ওয়ার লেটারস অ্যাট চ্যাপমেন ইউনিভার্সিটি। এটি ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের অরেঞ্জ সিটিতে অবস্থিত।

পত্র লেখক আর্মির তরুণ লেফটেন্যান্ট টমি কেনেডি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি জাপানের যুদ্ধ শিবিরে তখন বন্দী। তত দিনে টমি জেনে গেছেন জীবিত অবস্থায় দেশে ফেরা তাঁর কপালে নেই। একটি পারিবারিক ছবির উল্টো দিকে বাবা-মাকে চিঠি লিখে তিনি আরেকজন সহযোদ্ধার হাতে দেন। যুদ্ধ শেষ হলে সহযোদ্ধা চিঠিটি টমির মা-বাবার হাতে তুলে দেন। চিঠিতে লেখা ছিল—

মা ও বাবা,

এভাবে কোনো যুদ্ধ ব্যতীত মরে যাওয়াটা বেশ কঠিন। কিন্তু আমরা তো চিরকাল বেঁচে থাকতে পারি না। মরতে আমি ভয় পাই না, কেবল তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা না হওয়ার এই চিন্তাটা আমি ভারী অপছন্দ করি। আমার পাঠানো টাকা দিয়ে ‘টার্কি র‍্যাঞ্চ’ কিনে নিও আর আমাকে মনে করো যখন-তখন। আমার দুই বোনকে মন উজাড় করে টাকা-পয়সা দিও।

কলেজের প্রথম বর্ষে ব্যারির যেন নিজের একটা গাড়ি থাকে। আর প্যাটিকে কথাটা বলেই দিও যে, নিয়তি চায় না আমাদের আবার মিলন হোক। আমার জন্য সুন্দর একটা প্রার্থনার ব্যবস্থা কর আর আমার কবরের ওপর খোদাই করা একখণ্ড প্রস্তর যেন থাকে।

আমার ভাগনে-ভাগনিদের প্রতি খেয়াল রেখো। ওরা যেন কোনো জিনিসের এমন কাঙাল না হয়, যেমনটি আমি হয়েছি একটুখানি পানি বা স্নেহের পরশের জন্য।

ভালোবাসা আর অপেক্ষায় তোমাদের জন্য আরেক পৃথিবীতে

তোমাদের পুত্র

লেফটেন্যান্ট টমি কেনেডি।

যুদ্ধ সব সময় বিভীষিকাময়। তবুও এসব চিঠিতে ফুটে ওঠা সৈনিকদের ব্যক্তিগত জীবনের আবেগস্পর্শী ঘটনা পড়লে মনে হয় যেন পাশের বাড়ির কারও সুখ-দুঃখের গল্প শুনছি।

তথ্যসূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট, অক্টোবর ২০২০