Thank you for trying Sticky AMP!!

জর্জ ফ্লয়েড হত্যা কি বদলে দেবে অনেক কিছু

এই মহামারির সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান আন্দোলন মনে করিয়ে দিচ্ছে শত বছর আগের অনুরূপ এক মহামারি সময়ের কথা। জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে ৬ জুন নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে সমবেত বিক্ষোভকারীরা। ছবি: রয়টার্স

খড়ের গাদায় আগুন লাগলে কী হয়, তার উত্তর সহজ—সব পুড়ে ছাই। অবশ্য 'দোকান থেকে চাল আসে'—ধারণা বহনকারী প্রজন্মের উত্তর কী হবে বোঝা মুশকিল। সে যা–ই হোক, খড়ের গাদায় আগুন লাগে কখনো কখনো অনেকটা অজান্তেই। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যেমনটা হচ্ছে আর কি। এ আগুনের ভবিষ্যৎ কী, তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। তবে বৈশ্বিক কেন্দ্রটিতে ছড়িয়ে পড়া এমন অস্থিরতা পুনর্বিন্যাসের সম্ভাবনা দেখায়।

আজ সবাই এক বৈশ্বিক মহামারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন বৈশ্বিক মহামারি দেখা গিয়েছিল ১৯১৮ সালেও, যা নানাভাবেই পরিবর্তনের স্মারক হয়ে আছে। তাকানো যাক ১০২ বছর আগের জুন মাসের দিকে। এই জুন যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশেষ হয়ে উঠেছে একজন জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা এবং সেই সূত্রে নাগরিক আন্দোলনের বড়সড় ঢেউয়ের কারণে, সেই জুনও ছিল দেশটির জন্য বিশেষ। আজকেরটি যদি নেতিবাচক অর্থে হয়, তবে ১৯১৮ সালের জুন ছিল দেশটির জন্য ভীষণভাবে ইতিবাচক।

১৯১৮ সালের জুন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বমঞ্চে নতুন মহাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। সেই জুনের ১ তারিখ যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ইউরোপীয়দের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাতে নিজেকে জড়িয়ে বিশ্বকে নিজের আগমনবার্তাটি জানিয়ে দেয় দেশটি। যুদ্ধের ময়দানে যুক্তরাষ্ট্রের এই সক্রিয় হয়ে ওঠাটা মহাযুদ্ধের ফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।

১৯১৮ সালের এমন জুন মাসেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যা ছিল পরাশক্তি হিসেবে দেশটির নিজের অস্তিত্বের জানান। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যখন ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলো নিজের শক্তিক্ষয় করছে, ঠিক তখন ভেতরে ভেতরে এক অণুজীব ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। গুলি ও বেয়োনেটের আঘাতেই শুধু নয়, মানুষ মরছে তখন ইনফ্লুয়েঞ্জায়ও। যুদ্ধরত সব দেশ ভাবল, এ বুঝি তাদের একার যন্ত্রণা। তাই তারা এভাবে ভেতরে ভেতরে লোকক্ষয়ের কথা লুকাতে চাইল। ফলে সবাই চেপে গেল ইনফ্লুয়েঞ্জার খবর, এক স্পেন ছাড়া। স্পেন যুদ্ধে ছিল না বলে, তারা সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত হয়নি। ফলে মহামারিটির নাম হয়ে যায় স্প্যানিশ ফ্লু (স্পেনের লোকেরা অবশ্য একে বলত ফ্রেঞ্চ ফ্লু), যা এই জুনের শুরুতেই বৈশ্বিক মহামারি বা প্যান্ডেমিক হিসেবে স্বীকৃত হয়।

বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে স্প্যানিশ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা যখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, তার ঠিক আগে আগে বিশ্বে ঘটে গেছে এক অভিনব ঘটনা। অক্টোবর বিপ্লব। এর আগেই অবশ্য রাশিয়া মহামারির এক ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু ১৯১৭ সালের পর সদ্যোজাত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ভেতর–বাহির দুই দিকের ধাক্কায় পর্যুদস্ত। শত বছর আগের ওই মহামারিটি তাই ছিল বিশ্বের ইতিহাস বদলের এক ক্রান্তিলগ্ন নিঃসন্দেহে।

সদ্য প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়, তখন অঞ্চলটি ছিল গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত। এই জুনেই রুশ দেশে শুরু হয় ওয়ার কমিউনিজমের কাল, যা অব্যাহত ছিল ১৯২১ সালের মার্চ পর্যন্ত। এই সময়ে রাশিয়ার ভেতরে যেমন চলছে বিপ্লবী–প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, তেমনি বাইরের দুনিয়ায় বিশেষত প্রথম মহাযুদ্ধে নিজেদের অবস্থান নিয়েও চলছে নানা সংকট। নতুন সমাজতন্ত্রী সরকার নতুন ভূমি আইন, জাতীয়করণ, নতুন বিনিময় প্রথা এবং উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থার নতুন কাঠামো ইত্যাদি হাজির করে সবকিছু নতুন করে সাজাতে ব্যস্ত। 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন' তখনো প্রতিদিন নতুন নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়েই রুশ দেশে হানা দেওয়া ফ্লু ১৯২০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কেড়ে নিল মতান্তরে ৫–২৫ লাখ মানুষের প্রাণ।

স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই রুশ দেশে হয়ে গেছে বিপ্লব। মহামারির সময়ও চলছে নানা ভাঙাগড়া। ছবি: সংগৃহীত

শত বছর আগের এই সময়ে বিশ্ব তাই একই সঙ্গে দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের এক নতুন বৈশ্বিক ধারণার নির্মাণযন্ত্রণা, যারা সময়ের সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে চরম বিরোধে লিপ্ত হবে, যা স্নায়ুযুদ্ধ নামে দশকের পর দশক ধরে ব্যতিব্যস্ত রাখবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে। এই একই সময় একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পুরোনো সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শক্তিক্ষয়ের কাল হিসেবে। নয়া অর্থনৈতিক ধারার জন্য যে পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন পড়ল, তা করতে গিয়ে নিজেরাই নিজেদের ক্ষয়ে দিতে থাকল তারা। আর এই বিবাদের মধ্যেই প্রকট হলো দুই বিপরীত ঘরানা—বেনিয়া বনাম শ্রমিক শ্রেণি।

আজকের সময়ের দিকে তাকালে অনুরূপ একটি মহামারির দেখা যেমন মেলে, তেমনি দেখা যাচ্ছে শক্তির উত্থান ও পতনের নানা চিহ্নও। শত বছর আগের মতো এবারও মহামারির সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা। আগেরবারের মতোই এবারও সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল চীন ও এর আশপাশের দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে দুটি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়। প্রথমত, চীনের বহু অংশ তখনো ঔপনিবেশিক শক্তির বাইরে রয়ে গেছে। ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জা সেখানে সংক্রমণের ফুরসতটি পায়নি। দ্বিতীয়ত, চীনের ঐতিহ্যগত চিকিৎসাপদ্ধতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা আগে থেকেই মহামারি–সংক্রান্ত বিদ্যায় এগিয়ে ছিল। এবারও কিন্তু চীনের দিকে তাকালে তেমনটিই মনে হচ্ছে। কোভিড–১৯–এর যাত্রা বিন্দুটি চীনে থাকলেও, তা চীনের তুলনায় অন্য দেশগুলোয় বেশি ক্ষতি করেছে।

শত বছর আগের মহামারির সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রবেশ করছে সৈনিক ও সেনাপতি হিসেবে। আর আজকের মহামারির সময়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছে আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে। শত বছর আগের সেই স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময়েই মূলত বিশ্ব দুটি রাজনৈতিক মেরুর জন্ম দেখে। ১৯৯০ সালের পর এর এক মেরু বিলোপ পায়, বিশ্ব মেনে নেয় অবশিষ্ট মেরু যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া শাসন। কিন্তু ২০০৮ সালের ধকল সয়ে এই সময়ে এসে এই যুক্তরাষ্ট্রই যেন আবার নতুন কোনো গল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাওয়া তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে এই জুনেই সূচনা হয়েছিল ওয়ার কমিউনিজমের, যা স্থায়ী হয়েছিল ১৯২১ সালের মার্চ পর্যন্ত।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক প্রভাববলয় অনেকটাই সংকুচিত করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে নিজের শক্তির ক্ষয় করে ফেলেছে দেশটি। এই মহামারির সময়ে বিশ্বকে নেতৃত্বও দিতে পারেনি। আর গত ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক ভয়াবহ অস্থির সময়ে প্রবেশ করল। এই সময়ে এসে এমনকি বিশ্বের বহু দেশে নানা ফ্রন্টে যুদ্ধ করা মার্কিন সেনাদের নিজ দেশে মোতায়েনের মতো প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়ে দিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। এই প্রস্তাব ভয়াবহভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে সবাইকে।

এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন, বিশ্বের যেকোনো দেশই অস্থির হয়ে উঠতে পারে, যেকোনো ঘটনায়। প্রথম ও প্রধান কারণ, মহামারি। মহামারির কারণে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব মেনে নেওয়া মানুষ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে আছে। ফলে এমন অস্থিরতা যখন–তখন যেকোনো স্থানেই জন্ম নিতে পারে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, খড়ের গাদা প্রস্তুত হয়েই আছে। এই খড়ের গাদাটি শুকনোও হতে পারে, আবার হতে পারে ভেজাও। ভেজা হলে ধোঁয়াই সার, মাঝখান থেকে কিছু লোকের চোখ জ্বালা করা ছাড়া কিছুই হবে না। আর শুকনো হলে রক্ষা নেই, দাউ দাউ আগুনে সব পুড়ে ছাই হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রে যে তোলপাড় দেখা যাচ্ছে, তা কি ধোঁয়ার কারণে সৃষ্ট, নাকি প্রকৃতই আগুন, তা সময়ই বলে দেবে। আর এই ধোঁয়া বা আগুনে কতটা কী পরিবর্তন আসবে, এক মেরু কত মেরুতে বদলাবে বা আদৌ বদলাবে কি না, তা কে বা জানে।