জীবনের এই বাঁকে

বুয়েট ১৯৯১ অ্যালামনাইর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা
বুয়েট ১৯৯১ অ্যালামনাইর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা

বুয়েট ১৯৯১ অ্যালামনাইর জমজমাট পুনর্মিলনী গত ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত মেরিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৫৫ জন প্রবাসী সতীর্থ সেখানে। তাঁদের একেক জনের পরিবারসহ প্রায় ১৭০ জনের একটি বৃহৎ পরিবার বলা যায়। হয়তো একজনের সঙ্গে আরেকজনের ২৭ বছর পর দেখা, এমন অনেক ঘটেছে। কাছে এসে চোখ সরু করে তাকিয়ে বলছে, ‘তুই শাহীন না? সোহরাওয়ার্দী হলের উত্তর দিকে থাকতিস?’

তাঁদের কোলাকুলি দেখে মনে হতে পারে, আজ ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা, দুটিই একযোগে হচ্ছে।

তাঁরা এসেছেন আমেরিকার নানা স্টেট থেকে। কেউ কানাডা থেকে গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। এমনকি কাতার থেকেও একজন মনের টানে পরিবার নিয়ে উপস্থিত। বাঁধ ভাঙা আনন্দ। ছেলে-মেয়েরা বাপ-মায়েদের কাণ্ড কীর্তি দেখে অবাক!

কীর্তির একটা বললেই বোঝা যাবে। যারা হোটেলে ছিলেন, তাঁরা রাত ১২টায় পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠান শেষ করে আবার হোটেলের লবিতে আড্ডায় বসছে। সেই আড্ডা চলছে ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত। পরদিন সকাল ১০টায় পিকনিক। সেখানেও পৌঁছে যাচ্ছেন ঠিকমতো। তারপর হঠাৎ চিৎকার। কলেজজীবনের মতো; প্রথমে একজন নিচু স্বরে স্লোগানের মতো কিছু বললেন, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কতিপয় ‘বখাটে’ হঠাৎ সমস্বরে ‘হুহ, হাহ’ বলে কাউকে খেপিয়ে তুললেন। তাতে আশপাশের মানুষদের অবাক হয়ে তাকাতে হচ্ছে।

এর মধ্যে আবার অনেক ট্যালেন্ট পাওয়া গেল। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তো বটেই, এই পঞ্চাশ ছোঁয়া সতীর্থদের যে এত গুণ ছিল, তা যে ২৭ বছরে আরও বেড়ে গেছে, এ দেখে আনন্দিত না হয়ে পারা যায় না। ২৭ জুলাই সন্ধ্যায় একটা মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে গেল। বুয়েট ১৯৯১ এর সতীর্থরা ২৫-২৬ বছর বিদেশে থাকার পরে কতটুকু বাঙালি সংস্কৃতিপ্রেমী হয়ে গেছে; তা ‘জীবনের এই বাঁকে, আপন আঙিনার স্বাদ’, অনুষ্ঠানের এই নামকরণ দেখেই বোঝা যায়।

সেখানে নতুন প্রজন্মের অনেকেই গান-নাচ দেখাল। একজন কিশোর স্কুলে মুসলিম অভিবাসী ছাত্রদের সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে চমৎকার একটা গল্প পড়ে শোনাল। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের খালেদের স্ত্রী জুলি মাহমুদ ভিনদেশি, ফিলিপাইনের। তিনি বিস্ময়কর ভাবে বাংলায়, সুরেলা গলায় ‘ও আমার ময়না গো’ গানটি গেয়ে শোনালেন। গান গাইলেন নিউইয়র্কের উদীচী গানের স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জীবন বিশ্বাস। প্রায় টিভি শিল্পীদের মতো করে গাইলেন নাট্যকার নজরুল ইসলামের স্ত্রী সাপাহার ইসলাম সিমি, ইঞ্জিনিয়ার শামসুল সিকদারের স্ত্রী রিমা এবং আরও কয়েকজন। 

এরপর বড় একটা বাঁশের বাঁশি নিয়ে উপস্থিত হলেন নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মোর্শেদ। তিনি অপূর্ব বাঁশি বাজিয়ে শোনালেন। পরে বন্ধুরা কৌতূহল বশে তাঁর কতটি বাঁশি আছে জিজ্ঞেস করলে জানা গেল—ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৮টা বাঁশি আটলান্টার মতো জায়গাতেই রয়েছে তাঁর।

ভার্জিনিয়া এলাকার সংস্কৃতি অঙ্গনে পরিচিত মুখ, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শফিকুল ইসলাম একটি মনোজ্ঞ ভিডিও নির্মাণ করেছেন। যেখানে বুয়েট নিজেই উত্তম পুরুষে ‘আমি’ বলে তার ইতিহাস বর্ণনা করছে। তাঁর স্ত্রী নুসরাত শফিক সোমা এবং বুয়েট ১৯৯১ এর সতীর্থ শামীমা আলী সোমা নিপুণভাবে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।

দুটা মজার নাটিকা ছিল। সেই নাটিকা যারা লিখেছেন এবং যারা অভিনয় করেছেন তাঁরা সবাই বুয়েটের একই ব্যাচের সতীর্থ। যেমন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সালাম আজাদ ও তাঁর স্ত্রী একই ব্যাচের রোকসানা আজাদ। তাঁরা দুজনে দেখালেন কীভাবে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বদলে যাচ্ছে। ‘আমাদের দাদাদের সময় গোলা ভরা ধান থাকত, ঘর ভরা বউ থাকত।’ সেই প্রজন্মের সময়টা এভাবে অভিনয় করে দেখালেন, বড় বউ বলছে, ‘ছোট বউয়ের মেজাজটা একটু চড়া, রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি তাকে।’ উত্তরে স্বামী জলদি গম্ভীর স্বরে বলছে, ‘তাঁকে আর আনতে হবে না, আমি আরেকটা বিয়ে করব।’ বিষয়টা নিছক হাসির। কিন্তু মানুষকে হাসানোটাই তো কঠিন কাজ?

এভাবে হালনাগাদে এসে দেখালেন, স্ত্রী সব সময় ফেসবুক নিয়ে পড়ে আছে। এদিকে স্বামীর ফোনে কেউ ফোন করেছে, নাম উঠেছে টুনটুনি। জিজ্ঞেস করাতে তিনি নার্ভাস হয়ে বলছেন, ‘ওহ, ওটা টুনটুনি ভাই।’ শেষে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে অনলাইন থেকে শাড়ি কিনে দিতে রাজি হওয়ায়, স্ত্রী খুশি হয়ে দুজনের একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলেন। তাতে প্রচুর লাভ, লাইক ও কমেন্টস পড়তে থাকল।

পরের ‘স্বামী ভাড়া’ নাটিকাটি লিখেছেন এবং অভিনয় করেছেন একই ব্যাচের সতীর্থ, নিউইয়র্কে বসবাসরত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নজরুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে অভিনয় করলেন সতীর্থ সাবিনা হাই উর্বি। এখানে দেখা গেল, ঘর ভাড়া, গাড়ি ভাড়ার মতো স্বামী ভাড়া করার নতুন এজেন্সি খুলে বসেছেন তিনি। এই নাটকে আবার অন্ত্যমিল দিয়ে ডায়ালগ, হীরক রাজার দেশের মতো। নারীর প্রশ্নের উত্তরে এজেন্সির মালিক এর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে বলছেন—বাসা ভাড়া নিতে গেলে আনম্যারেড নারীকে দেবেন না। সেখানে আপনি স্বামী ভাড়া করে নিয়ে গেলেন। সেই স্বামী হবে অভিনয়ে পোক্ত। কেউ বুঝতেই পারবে না যে নকল স্বামী।

নারী বললেন, বিয়ে না করলে তাঁর দাদা সম্পত্তি দিচ্ছেন না। সেই সম্পত্তি নেওয়ার জন্য নকল বিয়ে করতে হবে। কিন্তু তাঁর কোনো সাময়িক ‘ভাড়া’ স্বামীর ছবিই পছন্দ হচ্ছে না। শেষে চোখ পড়ল এজেন্সির মালিকের ওপর। তাঁর উচ্চতা জিজ্ঞেস করতেই তিনি প্রমাদ গুনলেন। ওই নারী তাঁকে কথা দিলেন, তাঁকেই ‘ভাড়া স্বামী’ হিসেবে নেবেন, এমনকি স্থায়ী হয়ে যেতে পারে বলে ভরসাও দিলেন। এইভাবে করতালির মধ্যে শেষ হলো বুয়েট ১৯৯১ অ্যালামনাইর দুটি সুলিখিত এবং সু-অভিনীত নাটিকা।

সবশেষে ছিল ডিসি ‘মেট্রো বাউল’ জাফর রহমানের বাউল গান। সেই গানে মেতে অনেকেই মঞ্চে উঠে এলেন এবং নাচতে শুরু করলেন। যেমন ইউটি ডালাসের কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর সাকিব হাসান যেভাবে কোমর দুলিয়ে নাচা শুরু করলেন, তাতে মনে হতে পারে যাত্রা-পালায় নাচ করাই তাঁর আগের জীবনের পেশা ছিল। সতীর্থদের অনেকে বলছেন, সাকিবের ট্যালেন্ট আসলে নাচের মধ্যেই।

শেষ হলো ডিসির বিখ্যাত পটোম্যাক রিভারে দিনভর ক্রুজের মাধ্যমে। কেউ বোট থেকে নামতে চায় না। নামার পরে আবার কেউ ডক থেকে সরতে চায় না। যখন যেতেই হলো, সেকি কোলাকুলি! যেন ভাই ভাইকে ছেড়ে একমুখী টিকিট কিনে মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমাচ্ছে! কিন্তু সবাই একেবারে চলে যায়নি। দেখলাম হোটেল থেকে জনা বিশেক রাত ১১টায় আরেক আড্ডার ছবি পাঠালেন। এখন আবার মেসেজ পাচ্ছি, ২০২১ এ বড় করে এভাবে পুনর্মিলনী হবে। অতদিন অপেক্ষা না করে ২০২০-এই বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ছোট পুনর্মিলনী করার বহু প্রস্তাব আসছে। আমি নিজেও একজন সতীর্থ। এঁদের পাগলামি দেখে প্রথমে হাসলাম। পরে দেখলাম হাসি আর আসছে না, বরং খারাপই লাগছে।