
জগতের অধিকাংশ পেশাই বৈশ্বিক জীবনকে সহজ, সুখী ও সমৃদ্ধ করতে ন্যস্ত। আর জীবন ও মৃত্যুর ঠিক মাঝখানে যেসব পেশা কাজ করে, তার প্রধানতম হচ্ছে চিকিৎসা। প্রতিটি মানুষ তার মেধা, দক্ষতা, জ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে সমাজে একটি অবস্থান তৈরি করে। কেউ কেউ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। কিন্তু অসুস্থ হলে সবাই শুধু একটি দেহে পরিণত হয়। তখন অনেকেই ঐশ্বরিক প্রার্থনার আশ্রয় নেয়। আর সৃষ্টিকর্তা তাঁর হাত প্রসারিত করেন চিকিৎসা সেবার মধ্য দিয়ে।
চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত মানুষেরা তাই এক অর্থে সৃষ্টিকর্তারই দূত। তাঁরা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ নিয়ে আসেন। চিকিৎসা দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেন, আনন্দ ফিরিয়ে দেন। কোনো কোনো হতভাগ্যের অবস্থার অবনতি ঘটে। কারও কারও জীবনাবসান হয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সৃষ্টিকর্তা যেন চিকিৎসা সেবকদের হাত দিয়েই তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেন। এই সময়ে প্রতিটি মানুষ তার প্রভাব প্রতিপত্তি তুচ্ছ করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে এই সেবকদের কাছে।
চিকিৎসাসেবা নিয়ে রটনা ও বিতর্কের অবসান নেই। এর প্রধান কারণ চিকিৎসা সেবকেরাও রক্তমাংসের মানুষ। তাঁদেরও দোষ-গুণ রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরাও সচ্ছলতা চান, বিলাসিতার স্বপ্ন দেখেন। স্বাভাবিক এসব জাগতিক লোভ তাঁদেরও পদস্খলনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে নিজেদের মোটা উপার্জন নিশ্চিত করেন। চিকিৎসক, নার্স, পরীক্ষাগার, ফার্মাসিস্ট, ইনস্যুরেন্স—সবাই মিলে এ ব্যবসায় মুনাফা অর্জনে লিপ্ত রয়েছে। উন্নত দেশ থেকে শুরু করে অনুন্নত দেশ—সর্বত্র এ অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এ অভিযোগ অযৌক্তিকও হয়। অসুখের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিতজনের মানসিক বিপর্যয় এমন অমূলক অভিযোগের জন্ম দিতে পারে।
তবে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে চিকিৎসাসেবার মহান দায়িত্ব পালনের এক অকল্পনীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেখছি আজকের দুর্যোগময় বিশ্বে। করোনাভাইরাস মানব সভ্যতার সব ভিত এক তুড়িতে উড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক কোনো পদ্ধতি বা কৌশলই করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে কিছু করতে পারছে না। বিশ্বব্যাপী এ যুদ্ধে এখন একমাত্র যোদ্ধা হলেন চিকিৎসাসেবা সংশ্লিষ্টরা। তাঁরাই সম্মুখযুদ্ধে লড়ছেন করোনাভাইরাসের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন—নিজেদেরও রক্তমাংসের দেহ রয়েছে, যা সহজেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
প্রথমদিকে করোনাভাইরাসের প্রকোপের তীব্রতা না বুঝেই হয়তো পেশাগত দায়িত্ব অনুযায়ী তাঁরা সেবা দিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ জেনে-বুঝেই তাঁরা নিজেদের করোনাভাইরাসের তোপের মুখে সঁপে দিচ্ছেন। সকল মানুষ যখন নিরাপত্তার জন্য ঘরে আরামে রয়েছেন, তখন চিকিৎসা সেবকের দল ছুটে বেড়াচ্ছেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণার তোয়াক্কা না করেই দিন-রাত তাঁরা অসুস্থদের পাশে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এ এমনই এক দুর্যোগময় মুহূর্ত, যখন অসুস্থের পাশে তার পরিবার বা বন্ধুরাও যেতে পারছে না। এমনকি শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সময়ও কোনো প্রিয়জনের স্পর্শ পাচ্ছে না। এ সময়গুলোতে একমাত্র চিকিৎসা সেবকরাই সঙ্গী; তাঁরাই প্রিয়জন, তাঁরাই ত্রাণকর্তা।
করোনাভাইরাসে সারা বিশ্বই আক্রান্ত হয়েছে এবং ক্রমাগত হচ্ছে। তবে কিছু কিছু দেশ ও শহর ভয়াবহভাবে আক্রান্ত। এসব অঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থা কোনোক্রমেই ভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণকে সামলানোর জন্য প্রস্তুত নয়। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে হাসপাতাল, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের সব ক্ষমতা। এ সীমিত ব্যবস্থা নিয়েই করোনাভাইরাসের অপরিসীম আক্রমণকে মোকাবিলা করছেন চিকিৎসা সেবকবৃন্দ। এমনকি নেই নিজেদের সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। উন্নত বিশ্বের হাসপাতালেও মাস্ক, হাতমোজা, সুরক্ষা পোশাকের অপ্রতুলতা ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর মূল্য দিচ্ছেন চিকিৎসা সেবকেরা। ধীরে ধীরে তাঁরাও সংক্রমণের স্বীকার হচ্ছেন। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আক্রান্ত চিকিৎসা সেবকের সংখ্যা। নিউইয়র্কের একটি প্রখ্যাত হাসপাতালের এক ঊর্ধ্বতন চিকিৎসক দিনরাত পরিশ্রম করতে করতে আজ সে হাসপাতালেই রোগশয্যায় শায়িত।
করোনাভাইরাসের মোকাবিলার জন্য মানবসভ্যতা একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল। সে কারণেই এর ভয়াবহতা মাত্রাতিরিক্ত। সাময়িক সমাধান হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্র একমাত্র সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও গৃহবন্দী থাকার পরামর্শ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি বা করতে পারেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, চিকিৎসা সেবকদের রক্ষা করতে তেমন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যেখানে রাতারাতি আণবিক বোমা তৈরি হতে পারে, সেখানে চিকিৎসা সেবকদের সুরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি ও সরবরাহে এত বিলম্ব কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। হাসপাতালে তাদের আহার, বিশ্রাম বা নিদ্রার কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই তাদের দিয়ে একটানা ২৪, ৩৬, ৭২ ঘণ্টা কাজ করানো হচ্ছে। তাদের রোগ প্রতিরোধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমি উন্নত দেশগুলোর কথাই বলছি, অনুন্নত দেশের কথা বাদই দিলাম। এ সেবকেরা যদি একে একে পর্যুদস্ত হতে থাকেন তবে মানবজাতিকে রক্ষা করার কেউ থাকবে না।
সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা কেবল মৃত্যুর মিছিল দেখি। কিন্তু রোগমুক্তির বিশাল মিছিল আমাদের লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। চিকিৎসা সেবকেরা ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে কত সহস্র মানুষকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিচ্ছেন, সে সংবাদের দিকে এখন আমাদের দৃষ্টিপাতের সময়। এ অমানিশা কাটবেই এবং নতুন ভোর মানবজাতি দেখবেই। সেই ভোরের স্নিগ্ধ আলোর সন্ধান আমরা পাব কেবল ওই চিকিৎসা সেবকদের হাত ধরেই।
জয়তু চিকিৎসাসেবা।
*লেখক: অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক