নাম মনে রাখুন
এই লেখা বাকিটুকু পড়ার আগে যদি আমি আপনাকে ছোট্ট একটা কাগজ বা মুঠোফোনে আপনার পছন্দের একটা নাম লিখতে বলি, আপনি কার নাম লিখবেন? নিশ্চয়ই আপনার বা আপনার প্রিয় কোনো মানুষের নাম! আপনি এটা পড়ে আরও অবাক হবেন যে আপনার প্রাইমারি স্কুল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন কাগজ, খাতা বা ডায়েরিতে আপনি আপনার মনের অজান্তেই যে নামটি সবচেয়ে বেশি লিখেছেন সেটি হলো আপনার নিজেরই নাম। কারণ প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নাম! ‘কতটুকু সুন্দর মানুষের কাছে তাঁর নিজের নাম?’ - এমন প্রশ্ন মাথায় এলে ২০১৪ সালে মার্চ মাসে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ক্লাসের ল্যাবে প্রায় ৭০জন ছাত্র-ছাত্রীর ‘সি’ প্রোগ্রামিং ভাষায় একটা নাম প্রিন্ট করতে বলি। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি সবাই প্রিন্ট করেছে তাদের নিজের নাম। মাত্র একজন প্রিন্ট করেছিল তাঁর মায়ের নাম! জীবনে সর্বমোট ১২বার বিভিন্ন সমুদ্র-সৈকতে গিয়েও দেখেছি মানুষ ভেজা বালুর মধ্যেই লিখছে তাঁরই নাম বা সেই নামের আদ্যক্ষর!
শুধু কী তাই? চিন্তা করে দেখছেন কখনো মানুষ তাঁর এই সুন্দর নাম অক্ষয় রাখতে কী না করছে? ২০১৮ সালে আমি ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন স্কলারশিপ ও ভবনের নামকরণের ইতিহাস জেনে অবাক হই কত কোটি-কোটি টাকার অনুদান রয়েছে সেসব স্কলারশিপ ও ভবনের নামকরণে। ২০১৯ সালে আমি সর্বমোট ৬টি মন্দির ও ২টি মসজিদের বিভিন্ন ভবনের নামকরণের ইতিহাস জানতে গিয়েও অবাক হই সেই অনুদানের পরিমাণ দেখে! এমনকি সেসব মন্দিরের বিভিন্ন নেমপ্লেটে শুধু একটা নাম লিখতে মানুষ দান করছে লাখ লাখ টাকা! মানুষ যদি নিজের নাম মনে রাখার জন্য এত কিছু করতে পারে, আপনি কী কখনো ভাবছেন আপনি তাঁর কত বড় আপনজন এবং প্রিয়পাত্র হতে পারবেন শুধু তাঁর নাম মনে রেখে?
ধরুন, আপনার কোনো এক প্রিয় ব্যক্তি বা শিক্ষক আপনার নাম ধরে ডাকছেন। কেমন লাগবে আপনার? নিশ্চয়ই ভাববেন তিনি আপনাকে খুবই ভালোবাসেন! আর সে জন্যই আপনিও তাঁকে ভালোবাসবেন। আমার এক সহকর্মী, জওহর লাল দাস সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক হয়েছিলেন শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের নাম মনে রেখে। তিনি প্রায় চার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর নাম মুখস্থ বলতে পারতেন! অতি অল্প বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসা নিয়ে পরপারে পাড়ি জমান এই জনপ্রিয় শিক্ষক। আজও স্যারের জন্মদিনে বা মৃত্যুদিবসে ছাত্র-ছাত্রীদের অকৃত্রিম ভালোবাসার স্মৃতিচারণে দেখি ছাত্র-ছাত্রীরা বলছে, “স্যার আমার নাম ধরে ডাকতেন”!
‘আপনার আশপাশে কিছু জনপ্রিয় মানুষের কথা ভাবুন। নিশ্চয়ই অনেক মানুষের নাম জানেন তাঁরা’। ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আমি এ রকম একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেসবুকে। সেই স্ট্যাটাস আমি শেয়ার করি আমার এক অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে এক আড্ডাতে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আজ পর্যন্ত মুঠোফোনে ও খাতায় লিখে প্রায় ৫৫০ জন সহকর্মীর নাম মনে রেখে আমাদের অফিসে সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব হন কুই লি! কীভাবে কুই মনে রেখেছিলেন সেসব নাম? তিনি বিভিন্ন মিটিং বা দুপুরের খাবারে কারও নাম জানার পর তাঁর মুঠোফোনে লিখে রাখতেন সেসব নাম। এমনকি লিফটে যাওয়া-আসার সময় মানুষের গলায় আইডি কার্ড দেখে তাঁদের নামও লিখে রাখতেন তাঁর মুঠোফোনে। পরবর্তীতে সেসব নাম তাঁর মনে না থাকলে তিনি তা লিখতেন তাঁর এক ডায়েরিতে। অফিসে অন্য কোনো মিটিং বা ক্যাফেটেরিয়াতে সেসব মানুষকে দেখলেই তিনি তাঁদের নাম ধরে ডেকে তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। এরপরও অনেক সময় তাঁদের নাম মনে না থাকলে তাড়াতাড়ি ডায়েরি দেখে মনে করতেন সেসব নাম। সবাই অবাক হয়ে কুইকে জিজ্ঞাসা করতেন তিনি কীভাবে তাঁদের নাম মনে রাখতেন! আর, এভাবেই মাত্র ৮মাসে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এই কুই লি। গত শুক্রবার কুই আমাদের অফিসে চাকরি ছেড়ে অন্য এক অফিসে যোগদান করেছেন আর আমাকে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে এক ই–মেইলে লিখেছেন এই গোপন তথ্য।
এই লেখা লেখার সময় আমি কুইকে ফোন করে তাঁর নতুন চাকরির জন্য অভিনন্দন জানাই। জানতে চাই নাম মনে রাখায় তাঁর সর্বোচ্চ অর্জন কী। উত্তরে কুই বলেন, ‘আমাদের কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজার জুলের ছেলের নাম এলি। এই নাম (এলি) আমি মনে রেখেছিলাম প্রায় ৬মাস আগে। কিছুদিন আগে জুল তাঁর ছেলের অসুস্থতার জন্য অফিসে আসেননি। আমি জুলকে ফোন করে এলির নাম ধরে তার খোঁজ-খবর নিই। এতে জুল এতই খুশি হন যে, তিনি বলেন তাঁর ২২বছরের চাকরি জীবনে আমিই প্রথম যে তাঁর ছেলের নাম মনে রেখেছি। দুই দিন পর জুল অফিসে এলে সর্বপ্রথম দেখা করেন আমার সঙ্গে। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার এর চেয়ে সহজ উপায় আর কী হতে পারে?’
তাই, আমি বলতে পারি, হাতেগোনা মাত্র পঞ্চাশ হাজার মানুষের শুধু নাম জেনে রীতিমতো তাঁদের খোঁজ-খবর নিয়ে দেখুন কী হয়! আপনি নিঃসন্দেহে সমগ্র বাংলাদেশে একজন জনপ্রিয় মানুষ হয়ে যাবেন খুবই কম সময়ে। শুধু কী তাই? বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আপনার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে চান? আপনার ইউনিয়নের ছোট-বড় প্রত্যেক মানুষের নাম মনে রেখে তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করুন; খোঁজ-খবর নিন। আমি বাজি রেখে বলতে পারি জনগণ আপনাকেই মনোনীত করবে পরবর্তী নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসেবে!
আমি শুনেছি আমাদের জনপ্রিয় লেখক, গবেষক ও অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারকে নাকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিতে চেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষার মান উন্নত করে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে। স্যার নাকি সেসব প্রস্তাবে তেমন সাড়া দেননি। চিন্তা করুন যদি প্রস্তাবটা এমন হতো, তাহলে কেমন হতো? ‘স্যার, আমরা আপনার নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ‘জাফর ইকবাল ইউনিভার্সিটি’। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের ৫টা সর্বোচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটাতে দেখতে উপাচার্য হিসেবে আপনার বিকল্প নেই। দয়া করে আমাদের ফেরাবেন না।’আমার মনে স্বপ্ন ও প্রশ্ন জাগে স্যার কি এমন একটা প্রস্তাব নাকচ করতে পারতেন?
আরও পড়ুন
-
ইরানে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর ঘণ্টাখানেক বেঁচে ছিলেন এক আরোহী
-
ইরানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের খুটিনাটি শুনলেন পুতিন
-
ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে এলাকা ভাগ করে দিতে বললেন প্রধানমন্ত্রী
-
প্রতারণা করে প্রবাসফেরত কর্মীদের টাকা নেন ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী, পরে ফেরত
-
রাইসি নিহত: পুতিন, সি, এরদোয়ানসহ বিশ্বনেতাদের শোক