বদলে যাওয়া নিউইয়র্কের অবরুদ্ধ জীবনে ডর আর ভয় নিত্য সঙ্গী। আগামীকাল কি হবে? চেনা–জানা কার কী খবর ফোনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে আসবে, তা নিজে যেমন জানি না, তেমনি জানেন শত হাজার প্রিয় নিউইয়র্কার। জীবনকে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। কিন্তু স্মৃতিকে বেঁধে রাখা কি তেমনি সহজ? স্বজন হারানোর কষ্ট আরা দুঃখের চলমান এরিনায় স্মৃতি রোমন্থনের বিলাস মুহূর্ত—
ভাবনা খোলা হাওয়ার জানালা খুঁজে নিয়েছে আমার এ অপারগতায়।
যতই নামুক কাল বৈশাখী
থাকবে রোদের খেলা
ঠিক আমাদের টেনে নিল
বৈশাখের মেলা।
মুসলিম উদ্দিন অর্জু বৈশাখকে আনন্দের
আদলে। রোদের খেলাতে দেখলেন বলেই
বৈশাখ আমাদের সর্বজনীন উৎসব।
হাওর পাড়ে বৈশাখ, স্বপ্নে বোনা বাকি সময়টুকুন সুখে কাটানোর ব্যাপক ব্যস্ততার সবাক চিত্র। বাঙালি সমাজে বৈশাখ উৎসব পালনের ইতিহাস হাজার বছরের। উৎসব পালনের রীতি কিংবা রকম, বেশির ভাগ চিত্র এক হলেও হাওরের পাড়ে চিত্র কিছুটা ভিন্ন। একমাত্র ফসল বোরো ধান রোপিত হয় শীতের শেষে পৌষ মাসে। সেই ফসলের পূর্ণতা আসে চৈত্রের মাঝামাঝি। সারা হাওরপাড় জুড়ে শুরু ফসল তোলার সাজ সাজ রব। প্রস্তুতি চলে বাড়ির ভেতরে–বাইরে। শহুরে বৈশাখ উৎসবের শৌখিন পান্তা ভাত আর ভর্তা। কৃষক কামিনদের নিত্যবেলার মেনু। বৈশাখ উৎসবে এর যেমন স্থান নেই, তেমনি মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা প্রতি দিন কৃষকের মননে চিন্তায় থেকে যায়। আপন সন্তান–সন্ততি সব পাড়া প্রতিবেশীদের অকৃত্রিম মঙ্গল কামনা। তাই বুঝি ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই শুরু হয় পরিবার ও প্রতিবেশীদের হাঁক ডাকে জড়ো করে মুড়ি খই দিয়ে নাশতার পর্ব। স্ব স্ব ধর্ম অনুসারে সৃষ্টি কর্তার প্রতি সন্তুষ্টির উপাসনা। হয়তো তা গ্রামের মসজিদে, নয়তো অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে। গৃহকর্তার কপালে চিন্তার বলিরেখা।
গঞ্জের সারা বছরব্যাপী সদাইপাতির চূড়ান্ত হিসাব নিকেশ ৩০ চৈত্র। তিন মাসের মজুত ধানের শেষ চালান বিক্রি হয়ে ছিল বলে হাতে আছে নগদ কিছু টাকা। সেখানেই হাত দিতে হবে। ফসল তোলার খরচাপাতির জন্য রাখা জমানো পুঁজিতে। সেই সময় টুকুন আসুক। দেখা যাবে তখন। ওই যে বলে না। যখন যেমন তখন তেমন, সময় বুঝে কাজ। কানে আসে ছেলে–মেয়েদের বৈশাখী উৎসব নিয়ে নানা স্বপ্ন। বাবার সঙ্গে গঞ্জে যাবে বলে আগেভাগে বাজানকে বলে রাখা। বড় মনোহারী দোকান শশী বাবুর গদি ঘরে মিষ্টি খাওয়া। সবাই বলাবলি করে। গঞ্জের দোকানের মিষ্টি মণ্ডা সব আসে। শহরের নামকরা মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে। তাই বোধকরি মণ্ডা মিঠাইয়ের স্বাদ অপূর্ব। পরে আরও দুচার খানা গদি ঘরে বাবার সঙ্গে থেকে মিষ্টির স্বাদ নেওয়া।
বেলা পড়ে গেলেই যেতে হবে বাজারের উত্তর মাথায়। ঘন সবুজ পাতার ছাতা নিয়ে দাঁড়ানো শতবর্ষী বট গাছের নিচে।
ওখানে যে মেলা বসে! পাতার বাঁশি, কটকটি বাজনা, মাটির পুতুলসহ আরও কত কিছু! সঙ্গে থাকত বাঁশের তৈরি ছোট ছোট লাঠির মাথায় লাগানো নানা জাতের মুখোশ। দু আনা করে এক–একটি। কে কোনটি নেবে, তা নিয়ে চলছে তুমুল যুদ্ধ। বাড়ি ফিরতে দু/এক কেজি গুড়ের তৈরি জিলাপি নিতেই হবে বাকি সবার জন্য। চৈত্রের শেষ সপ্তাহে শুরু বৈশাখী ফসল কাটা। হাওরের নিম্ন ভূমিসহ নদীর পাশে পলি মাটির চরের জমিতে ফলে আগাম জাতের বোরো ফসল। কালচে রঙের মোটা চালের ধান। চৈত্রের আকালে যেন বন্ধু বেশে ঘরে এল।
ঘরে-বাইরে কামলা কামিন সবাই ব্যস্ত। কাজের তাড়ায় সবাই দৌড়ের ওপরই আছে। আছরা নয়তো বাগধার জাতের আগাম বোরো ফসল তুলে এনে করতে হয় মোটা মোটা লাল চালের সংস্থান। মাড়াই ঝাড়াই করে বৈশাখের ফসল তোলার এই মহাযজ্ঞে তা যে কতটুকু সহায়তাকারী। তা শুধু হাওরের পাড়ের গৃহস্থপত্নীই জানেন। তবুও দিন গুনে রাখেন কবে আসবে পয়লা বৈশাখ। শত ব্যস্ততার মাঝে এই উৎসবের দিনে রাখেন বাড়তি আনন্দ যোগে ভালোমন্দ নানা পদের সন্দেশ পিঠে। হাওরের পাড়ের আমাদের মা–চাচিদের এই আদর সম্ভাসনের স্মৃতি আমি আজও নিয়ে বেড়াচ্ছি। বোরো ফসল তোলার সময় আমরা শখ করে গ্রামের বাড়ি যেতাম। পরিবারের সবার ব্যস্ততা ও কামলা–কামিনদের ছোটাছুটি হইচই ছিল দারুণ উপভোগ্য। গ্রামের এক প্রান্তে চলত সদ্য কাটা ধান মাড়াই। সঙ্গে সঙ্গে খড় আলাদা করে বড় বড় বস্তায় ধানভর্তি করে তোলা হত গরুর গাড়িতে।
সেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসাটাই ছিল মূল আকর্ষণ। সরু সরু আলপথ নয়তো গ্রামের প্রান্তর বেয়ে। হুট হাট বলে। গরুকে তাড়ায়ে নয় দাবিয়ে। ধানভর্তি গাড়ি চালানোর নিটোল আনন্দ আজও স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করছে। বাড়ির সামনে ছিল। ধান শুকানোর বিশেষ খোলা জায়গা। অনেকখানি জায়গাতে ঘাস বিচালি পরিষ্কার করে। গোবর মাটি দিয়ে লেপে রাখা হত। সেখানেই চলত ধান শুকানো। উঁচু ঢিবি মতো করে ধান সংরক্ষণ। গ্রামের ভাষায় খলা। সেখানে ফেরি করত মিষ্টি আলা, লেইস ফিতা চুড়ি বিক্রেতারা। না টাকা পয়সা দিয়ে নয়, চাচি ও বোনরা ধান দিয়ে কিনতেন শৌখিন সামগ্রী আর শখের মিঠাই জিলাপি। বৈশাখের প্রথম দিনের সবটাই ছিল উৎসবের আদলে। এ যেন প্রাণের উৎসব। পরিবার–পরিজন–স্বজন প্রতিবেশীদের নিয়ে মিলন মেলায় সম্প্রীতির মহা আনন্দের দিন।
খাবারে যেমন ছিল বৈচিত্র্য। তেমনি থাকত কিছু বিশেষ ধরনের নানা পিঠা–পুলির আয়োজন। ভোরের প্রাতরাশে ঘরে ভাজা মুড়ি খইয়ের সঙ্গে খাঁটি দুধের, ঘরে পাতা দই। সাদা ধব–ধবে পোক্ত নারিকেল কোরা ও সুমিষ্ট চাঁপা কলার বিরাট আয়োজন। অন্যটি ছিল জালি পিঠা দিয়ে বিন্নি চালের ক্ষীর খাওয়া। বোরো ধানের চারার জন্য রাখা শাইল জাতের ধান হতে তৈরি হত জালি পিঠা। চালের গুঁড়াকে কলাপাতায় মুড়ে চুলার মধ্যে পোড়ানো হত। কেউ কেউ আবার পানির ভাঁপে রেখে বানাতেন। দারুণ সুস্বাদু পিঠাগুলো। পোড়া কলা পাতা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খোলার সঙ্গে সঙ্গে নাকে এসে লাগত শাইল ধানের মাতাল করা বুনো ঘ্রাণ।
পিঠা ভেঙে ভেঙে খাও মরিচা গুড়ের তৈরি মজাদার বিন্নি চালের ক্ষীর দিয়ে। বিকেলে দল বেঁধে গঞ্জের মেলায় যাওয়া।
গ্রামের এক পাশে চলত ষাঁড়ের লড়াই। সঙ্গে হাডুডু ও কুস্তির বেশ বড়সড় আয়োজন। আশপাশের গ্রাম ভেঙে আসা লোকজনে মেলা হয় যেত জমজমাট। চলত নানা সওদাপাতি। গৃহস্থালি সামগ্রী হতে শুরু করে কিশোরীদের মুখে ঠোঁটে মাখার জন্য পাউডার লিপস্টিক সবই বিক্রি হয় দেদারসে। কতই না আনন্দ উল্লাস চারপাশে। উৎসবের রেশ যেন সবাইকে করে রাখে আমোদের আমেজে। চিরায়ত বাঙলার এই সর্বজনীন উৎসবে ধর্ম–বর্ণ–নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ। যেন হয়। আমাদের দেশ, আমাদের গর্বের জায়গা, আমাদের ঐতিহ্য। তাই আজ এই উৎসবের দিনে আমিও যুক্ত হতে চাই সেই ভালোবাসার আহ্বানে।
তাই তো গেয়ে উঠি—
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো...।