মিথিলা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে একাকী মনে। মনটা আজ খুব ফুরফুরে। কেন এত ভালো লাগছে, সে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে মনে মনে। আচ্ছা কেন আমার প্রতিদিন এ রকম ভালো লাগে না? মিথিলা আজ বেশ সাজগোজ করেই বের হয়েছে। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক। লাল সবুজ সালোয়ার কামিজ, হাতে কালো রঙের ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস। একরাশি চুলগুলো খোলা মনে হাওয়ায় দুলছে, সঙ্গে যেন ওর মনটাও আজ দুলছে।
অন্যদিন বাইরে বের হলে রিকশা না পেলে দাঁড়িয়েই থাকে মিথিলা, হাঁটার অভ্যাস একেবারে নেই। কিন্তু আজ সে হাঁটছে, হাঁটতে তার আজ খুব ভালো লাগছে। সকালের কড়া রোদে হাঁটতে বেশ লাগছে। চারদিকে কত রিকশা ড্রাইভার আজ জিজ্ঞেস করছে, আপা রিকশা লাগবে? মিথিলা ‘না’ বলে, আর মনে মনে ভাবে, প্রতিদিন তো কত রিকশা খুঁজতে হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বেশির ভাগ ড্রাইভারই বলে টিপ, টিপ আছে। রোজ রোজ এ কথা শুনে একদিন মিথিলা এক ড্রাইভারকে হেসে হেসে বলেই দিল, আপনার কপালে তো কোনো সাদা, কালো কিংবা লাল টিপ নাই ভাই। মাঝে মাঝে সে এমন করে মজা করে কথা বলে, এটা তার অভ্যাস। আজ রিকশার প্রয়োজন নেই, তাই ড্রাইভারদের দরদ বেড়ে গেছে।
মিথিলা আবার হাঁটা শুরু করল, আর বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। একটু পর পরই ঘড়ি দেখছে, কিন্তু ঘড়িতে বারবার একই সময় দেখছে ‘৯.৩০’, এর মানে কি? ঘড়ির কাঁটা কি লাইফ সাপোর্টে আছে নাকি? ঘড়ির কাঁটা তো চলছেই না।
সে রাস্তায় হাঁটছে, তার কেন যেন মনে হচ্ছে, তার দিকে আজ সবাই তাকিয়ে আছে, দূর ছাই এসব কেন মনে হচ্ছে? আমি তো এমন কিছু না, কেন সবাই আমার দিকে তাকাবে? মনে মনে আবার ভাবে, দূর এসব আমার মনের ভুল, আশপাশের মানুষগুলো তাদের ব্যস্ততা নিয়ে আছে। বরং আমিই হয়তো ওদের দিকে বারবার তাকাচ্ছি। মিথিলা নিজেকে শুধরে আবারও হাঁটছে।
হঠাৎ তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
–দেখল অপরিচিত নম্বর। ফোন ধরে জিজ্ঞেস করল, কে বলছেন?
–অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এল আমি।
–আমিটা কে?
–আবার অপর প্রান্ত থেকে আবার বলে উঠল আমি।
এভাবে মিথিলা যতবার বলছে কে? ততবারই অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠছে আমি, আমি, আমি।
মিথিলার মেজাজ খারাপ হলো, অহ আপনার নাম কি ‘আমি’? আচ্ছা বলেন তো কাকে চাচ্ছেন?
–আপনাকে। মানে? জি, সত্যি আপনাকে চাচ্ছি।
মিথিলা এবার কড়া গলায় বলল, কী দরকার বলেন, না হয় ফোন রাখেন।
অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠল, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।
–মানে কী, আপনি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন? মিথিলা প্রশ্ন করে, আপনি কি আমার আশপাশে আছেন?
–জি, আপনার আশপাশেই আছি, আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।
–অহ, ঠিক আছে, আমার সামনে আসেন। আপনাকে দেখতে চাই।
অপর প্রান্ত থেকে বলল, কাছে আসলে কি মারবেন? যেমন করে বাংলা সিনেমায় নায়িকা চড় মারে।
মিথিলা বলে, আমি তো বাংলা সিনেমার নায়িকা না, আপনিও নায়ক না। সুতরাং সামনে আসতেই পারেন, মানুষকে আমি সম্মান করি, মারব কেন?
–সত্যি বলছেন তো?
মিথিলা বলে, জি, সত্যি বলছি আসেন সামনে।
এভাবে কথা বলে বলে মিথিলা হাঁটছিল, হঠাৎ একটা মোটরবাইক সামনে এসে থামল। মিথিলা ভয় পেয়ে হাতের ব্যাগটা বেশ জোরেই ধরল, ভাবল, যা দিনকাল আজ, কোন ছিনতাইকারী পথরোধ করল কি-না।
ছেলেটি অভয় দিয়ে বলল, আমি-ই টেলিফোনের সেই ব্যক্তি যার সঙ্গে এত সময় কথা বলছিলেন। আমার নাম শোভন চৌধুরী, ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে আছি ফাইনাল ইয়ারে। তোমাকে ভার্সিটিতে দেখছি অনেক দিন, কথা বলার চেষ্টা করলেও সাহস হয়নি। আজ হঠাৎ কোথা থেকে যে এত সাহস এল, একেবারে তোমার সামনে চলে আসলাম।
মিথিলাও শোভনকে চিনতে পারল, ভার্সিটিতে দেখেছে। তা ছাড়া তার এক বান্ধবীর বড় ভাই শোভন। কিন্তু সরাসরি কথা হয়নি কখনো।
শোভন বলে উঠল, তোমার বান্ধবীর কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়েছি। আমি তোমার অনেক কিছুই জানি। কিন্তু সামনে এসে কথা বলতে সাহস হয় না। আজ হঠাৎ করেই তোমাকে রাস্তায় দেখে ভাবলাম, একটু চমকে দিই। সাহস করেই তাই ফোন দিলাম। আর যেহেতু তুমি অভয় দিয়েছ যে মারবে না, তাই সামনে চলে আসলাম।
মিথিলা শোভনের কথা শুনে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
শোভন বলল, কই যাবে, আমি কি তোমাকে ড্রপ দিতে পারি? নতুন বাইক কিনেছি, তাই ভাবলাম একটু হাওয়া খাই।
–আমি আপনার বাইকে উঠব না, অপরিচিতি কারও গাড়িতে উঠি না।
শোভন বলল, আমি তো তোমার অপরিচিত না। আমি অনেক দিন থেকে তোমাকে চিনি, বলতে পার তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। সেই সুবাদে তোমার সম্পর্কে আমার জানাশোনার দরকার ছিল, তাই অনেক দিন ধরে ফলো করেছি বলতে পার। তা ছাড়া তোমার বান্ধবীর কাছ থেকেও সব সময় খবর নিয়েছি। যদিও এভাবে বলা ঠিক না, হয়তো ভাবছ রাস্তায় ইভটিজিং করছি। কিন্তু সত্যি বলছি। আমার মা খুব অসুস্থ, তাই বাবা-মায়ের খুব ইচ্ছা, আমাকে একটা টুকটুকে বউ এনে আমার পায়ে শিকল পরিয়ে দেওয়ার। তোমার কথা মাকেও বলেছি।
মিথিলা বলে উঠল, আপনি আমাকে চিনেন, কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না।
শোভন বলে উঠল, চল আজ থেকে দুজনার মাঝে চেনা–জানা হোক। আমার নম্বরটি সেভ করে নেবে। ভালো লাগলে কথা বলবে, তা ছাড়া একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি। তোমার কোন সাহায্যেও তো লাগতে পারি, বলা তো যায় না। নম্বরটি রাখো। একজন ভালো বন্ধুও ভাবতে পার আমাকে।
মিথিলা শোভনের এসব কথা শুনে বলল, ঠিক আছে সেভ করে রাখছি।
শোভন বলল, আমাকে ফোন দিয়ো। আজ আমি অপেক্ষায় থাকব তোমার ফোনের।
মিথিলা আর কোন কথা না বাড়িয়ে বলল, আপনি ভালো থাকুন, পরে কথা হবে আপনার সঙ্গে—এই বলেই মিথিলা আবার হাঁটতে শুরু করল। মিথিলা কিছুক্ষণ হাঁটার পর মেইন রোডে আসল, দেখল ইরফান একটি কালো রঙের প্রাইভেট কার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিথিলা তাকে দেখে দূর থেকে হাসল, সেও হাসল।
ইরফানের সঙ্গে বেশ কিছুদিন হলো ফেসবুকে পরিচয়। ইরফানকে সে ভালো বন্ধুই মনে করে, এর আগেও ইরফানের সঙ্গে দু/একবার দেখা হয়েছে, চা-কফি খাওয়া হয়েছে কিন্তু দূরে কোথাও যায়নি।
ইরফান প্রায়ই বলে, চলো লং ড্রাইভে যাই। কিন্তু মিথিলা রাজি হয় না, নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। তা ছাড়া লং ড্রাইভে যেতে কেন জানি তার ভয়ও কাজ করে। প্রতিদিন কত কী ঘটছে আজকাল! কিন্তু আজ সে ইরফানকে না বলতে পারেনি, কারণ আজ ইরফানের জন্মদিন। সে জন্মদিনে কেবল মিথিলার সঙ্গে সময় কাটাতে চায়, অনেক আগ থেকেই সে এ কথা বলে আসছে। কোনো উপায় না দেখে মিথিলা রাজি হয়েছে।
ইরফান বলেছে, জন্মদিনে তার খালার বাড়িতে যাবে, সেখানে পুকুর আছে, পুকুরে সে মাছ ধরবে মিথিলাকে নিয়ে। মিথিলারও খুব শখ মাছ ধরতে, তাই ভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে আজ সে ইরফানের প্রস্তাবে লং ড্রাইভে যাচ্ছে। ইরফান একজন ব্যবসায়ী। ফেসবুকে তার সঙ্গে পরিচয় হয় মিথিলার।
আজ ইরফান একটা লাল গেঞ্জি পরেছে, চোখে সানগ্লাস। গাড়ি চলছে, মিথিলা আর ইরফান গল্প করছে।
ইরফান বলে উঠল, মিথিলা তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, মিথিলা লজ্জা পায়। তোমার হাতটা দাও ধরি।
মিথিলা বলে, না, তুমি এখন গাড়ি চালাচ্ছ অ্যাক্সিডেন্ট হবে, না হবে না। দাও না হাত—এই বলেই ইরফান নিজেই মিথিলার হাতটা ধরে নিল তার কাছে।
ইরফান বলল, আমরা কই যাচ্ছি জানো?
–কেন তোমার খালার বাসায় যে বললে।
–না, খালার বাড়িতে যাব না, আমার এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে যাচ্ছি।
মিথিলা বলে উঠে, না, আমি তোমার বন্ধুর ফ্ল্যাটে যাব না।
ইরফান বলে, কোন সমস্যা নেই লক্ষ্মীটি, সে একা থাকে।
–না আমি তোমার বন্ধুর একা ফ্ল্যাটে যাব না, তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যে বললে কেন? এমনতো কথা ছিল না, মিথ্যে বলে কেন আমাকে নিয়ে এলে? তুমি গাড়ি থামাও, আমি আমি নেমে যাব।
ইরফান মিথিলার কোন কথা না শুনে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়।
মিথিলা বলে, কি হচ্ছে ইরফান এসব? তুমি মিথ্যে বলে আমাকে যেখানে–সেখানে নিয়ে যেতে পার না। প্লিজ তুমি গাড়ি থামাও।
কিন্তু ইরফান মিথিলার কোন কথাই শুনে না। এবার মিথিলা ভয় পেয়ে যায়, ইরফানকে এখন অনেক অচেনা–অচেনা লাগছে। কেন ইরফান এমন করছে আজ সে ভেবে পাচ্ছে না। বন্ধু মানে তো বিশ্বাস, ভালো লাগা। এখন তো মিথিলা এসব কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ইরফানের মধ্যে। কত অপরিচিত লাগছে তাকে, কী করবে সে, মনে মনে ভয় পাচ্ছে।
মিথিলা বারবার বলার পরও ইরফানের কোন পরিবর্তন নেই, সে স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে যেন পাশে বসা এক দানব। মিথিলা ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে!
ইরফান হাসিমুখে বলল, আসো আমার বুকে, কিছু আদর দিই সোনা, কিছু রোমান্টিক সেলফি তুলি।
মিথিলা কিছুই ভেবে পাচ্ছে না, কী বলবে। তারপর অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, ওই যে সামনে দোকান আছে ওইখানে পানি কিনো, খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
ইরফান কী যেন একটু ভাবল। পরে বলল, ওকে তুমি গাড়িতে বস, আমি পানি নিয়ে আসছি। সে একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে।
মিথিলা ভাবে, আগে তো কখনো ইরফানকে এত স্মোক করতে দেখিনি। তবে আজ কেন এত স্মোক করছে? ইরফানকে আজ উগ্র আর বখাটে কেন লাগছে? এই ইরফানের রূপ তো আগে দেখেনি, মিলাতে পারছি না কিছুই।
ইরফান দোকানের দিকে যাচ্ছে আর মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। মিথিলা খুব ভয় পাচ্ছে, আজ ইরফানকে তার পর পর মনে হচ্ছে, অচেনা লাগছে, যেন এই ইরফানের সঙ্গে কোন ভালোবাসার লেনদেন নেই। সে গাড়ি থেকে বের হওয়ার চিন্তা করল। কিন্তু দেখল গাড়ি লক করা, আরও ভয় পেয়ে গেল। কী করবে এখন সে? এর আগেও ইরফানের সঙ্গে দুবার দেখা হয়েছে, পাশে বসে ফাস্ট ফুড খেয়েছে। কত আপন মনে হয়েছে তখন! কিন্তু আজ তো পুরো উল্টো দেখাচ্ছে ইরফানকে। বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে সে, কাকে ফোন দিয়ে সাহায্য চাইবে। ঠিক তখনই মনে হল, সকালে যে শোভন চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়েছিল তাকেই ফোন দিই।
যেই ভাবা সেই কাজ, সঙ্গে সঙ্গেই মিথিলা তাকে ফোন দিল, কোন ভণিতা না করেই বলল, আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমি একটা সমস্যায় পড়ছি।
শোভন বলল, কি করতে হবে?
মিথিলা সবকিছু খুলে বলে।
সব শুনে শোভন বলে, যদি পার ছেলেটির একটা ছবি দাও। তুমি ভয় পেয়ো না, আমি আসছি। আর যে জায়গার কথা বলছ সেখানে আমার অনেক পরিচিতজন আছে, আমি ওদের ফোন দিচ্ছি। তুমি শুধু স্বাভাবিক থাকো।
ইরফান মিথিলাকে পানি দিয়ে গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে খুব নিচু স্বরে যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। কিছু বুঝতে না পারলেও মিথিলা বুঝতে পারছে, সে কোনো সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে।
মিথিলা গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য লক খুলতে বললেও ইরফান খুলে দিল না। আবার গাড়ি চলতে শুরু করল খুব স্পিডে।
মিথিলা বলে, আস্তে গাড়ি চালাও—এ কথা শুনে ইরফান ওর দিকে তাকিয়ে বেশ বড় গলায় হেসে বলে, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
–না, তবে তোমাকে খুব অন্য রকম লাগছে।
–শুনো ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে খাব না।
কিছুক্ষণ ওরা নীরব! মিথিলা দেখছে, ইরফানের ফোন ভাইব্রেশনে রাখা, বারবার ফোন আসছে কিন্তু সে ধরছে না। সে কেন ফোন ধরছে না, কার ফোন হতে পারে, সেটা মিথিলাকে খুব ভাবাচ্ছে।
মিথিলা বলল, ফোন ধরো, বারবার ফোন আসছে দরকারি হতে পারে।
হঠাৎ ইরফান গাড়ি থামাল, গাড়ি থেকে বের হয়ে ফোন ধরে আবার কথা বলা শুরু করল। আবারও মিথিলা দেখতে পায়, গাড়ি লক করা। কেন সে বারবার গাড়ি লক করছে।
এবার মিথিলা বলে উঠল, লক খুলো, বাইরে বের হব।
ইরফান গাড়ির লক খুলে না দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে একটার পর একটা আর ফোনে কথা বলছে। যেখানে দাঁড়িয়েছে সে জায়গাটা একটু নীরবই বলা যায়। মাঝে মাঝে ২/১টি গাড়ি রাস্তায় চলাচল করছে।
এবার মিথিলা বেশ জোরে কঠিন গলায় বলল, ইরফান কি হয়েছে? তোমার গাড়ি লক করে রাখছ কেন? আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছ কেন? কী এমন গোপন কথা তোমার, যা আমার সামনে বলা যাবে না?
মিথিলা বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে, কিন্তু ইরফান নীরব। সে ফোনে কথা বলছেই তো বলছে, মিথিলার কথা শুনেই না যেন সে। মিথিলার ভয়ের মাত্রা বাড়তে থাকে। সে আবারও শোভনকে মেসেজ দেয়, গাড়ি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার কথা বলে। শোভন সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ রিপ্লে করে, আমি বাইকে আসছি, তোমার প্রায় কাছাকাছি।
হঠাৎ করেই ইরফান গাড়ির দরজা খুলে মিথিলার পাশে বসল, বেশ একটু জড়িয়ে ধরে মিথিলাকে বলে তোমার মোবাইল ফোনটি দাও।
–কেন?
–আমার ফোনের ব্যালেন্স শেষ, তাই।
মিথিলা কিছু বলার আগেই হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয় ইরফান। ভাগ্যিস, শোভনের মেসেজগুলো সে আগেই মুছে ফেলেছিল।
মিথিলা ইরফানকে বলে, কেন তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে?
ইরফান গলা ছেড়ে হাসে। মিথিলা ভয়ে মনে মনে কাঁপতে থাকে।
–দেখো, তোমাকে ভালোবাসি বলেই আজ তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে ভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে বাসায় মিথ্যে বলে বের হয়েছি। কিন্তু তোমার মধ্যে তো আজ কোনো ভালোবাসার ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছি না, তোমাকে আমার ভয় লাগছে!
এবার ইরফান আবারও বড় করে হেসে বলল, ভালোবাসি বলেই তো তোমাকে আজ ওদের হাতে তুলে দিচ্ছি।
–মানে কি? কার হাতে দেবে? কি বলছ এসব?
ইরফান কোন উত্তর দেয় না।
মিথিলা বলে, আমার ফোনটা দাও, আমি চলে যাব বাড়িতে। বাড়ি থেকে কত কষ্ট করে বের হয়েছি শুধু তোমাকে ভালোবাসি বলে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমি অনেক বড় ভুল করেছি ইরফান। প্লিজ, তুমি আমার মোবাইলটা দাও, আমি চলে যাই।
ধমকের সুরে ইরফান বলে, বেশি কথা বলো না। চুপ করে বসে থাকো।
–কেন চুপ করে থাকব। আমি কি অপরাধ করেছি?
–বেশি কথা বলো না, তাহলে কালকের পত্রিকায় শিরোনাম হবে তোমার নাম। তোমাকে নিয়ে আমার ৬ মাসের প্ল্যান নষ্ট হবে, আমার এতগুলো টাকা কে দেবে?
–এসব কি বলছ ইরফান?
মিথিলা গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু করে, চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা, কে তাকে এখন বাঁচাবে? মিথিলাও বাঁচার তাগিদে ইরফানকে ধাক্কা মারে, চড় মারে। কিন্তু কোন কিছুতে কাজ হয় না।
ইরফান বারবার বলতে থাকে, তুমি জানো না, আমি কে? অনেক কষ্টে তোমাকে আজ এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি—এই বলে ইরফানও জোরে জোরে মিথিলাকে চড় মারতে থাকে।
মিথিলা কান্নায় ভেঙে পড়ে, বলতে থাকে, ইরফান আমি জানি না, তুমি কে? তবে তোমাকে ভালোবাসি—এ কথা সত্য। কেন তুমি এমন করছ আমার সঙ্গে? আমাকে বাড়ি যেতে দাও, আমি অনেক বড় ভুল করেছি তোমাকে বিশ্বাস করে। তোমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে। শুধু লোকমুখে শোনা যেত, ফেসবুকের ভয়ংকর কাহিনি। কিন্তু আমার জীবনের এ রকম কাহিনি ঘটবে ভাবতেও পারিনি। তুমি ভালোবাসার অভিনয় করে আমাকে ফাঁদে ফেলবে।
–হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। তুমি আমার ফাঁদেই পড়েছ সোনা। শোন, আমি কোন বড় ব্যবসায়ী না। আমার ব্যবসা মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে মেয়েদের ফাঁদে ফেলে টাকা ইনকাম। তোমার মোবাইল, গলায় স্বর্ণের চেইন আছে, ওটা দাও।
–ঠিক আছে, নিয়ে যাও। আমাকে বাড়িতে যেতে দাও।
–না, ফ্ল্যাটে যেতে হবে। সেখানে আমার দুই বন্ধু তোমার অপেক্ষায় আছে। তাদের কাছ থেকে আমি টাকা নিয়েছি।
এ কথা শুনে মিথিলা ইরফানের গালে চড় মারে। ইরফানও পাল্টা বেশ জোরে জোরে মারতে থাকে মিথিলাকে। মিথিলা কান্নায় ভেঙে পড়ে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে।
এমন সময় হঠাৎ একটা বাইক এসে ইরফানের গাড়ির গতি রোধ করে। ইরফান গাড়িটিকে ওভারটেক করে যেতে চাইলেও পারে না, দেখে পেছনে আরও দুটি বাইক।
গাড়ি থামিয়ে ওরা ইরফানকে গাড়ি থেকে বের করে আনে। কিল–ঘুষি মারতে থাকে। এরপর পুলিশে ফোন দেয়, যদিও শোভন আগে থেকেই পুলিশকে ইনফর্ম করে রেখেছিল ব্যাপারটি। পুলিশ এসে ইরফানকে ধরে নিয়ে যায়।
খোলা আকাশে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিথিলা কাঁদছে আর ভাবছে, কী বিপদ থেকেই না আল্লাহ বাঁচিয়েছেন তাকে। ফেসবুকে অল্পদিনের পরিচয়ে ইরফানকে ভালোবেসে আজ এভাবে লং ড্রাইভে বের হওয়া কত বড় বোকামি ছিল তার। আজ জীবনের সুন্দর সুন্দর স্বপ্নের মৃত্যু হতে পারত, কলঙ্কিত হতে হতো তার পরিবারকে। ভাগ্যিস আজ শোভনের সঙ্গে সকালে দেখা, সে তো ফেরেশতা। সে না বাঁচালে আজ কী হতো—ভাবতেই পারছে না মিথিলা।
শোভন মিথিলার হাত ধরে বলল, উঠো বাইকে, বাসায় পৌঁছে দিই। মিথিলা বাইকে উঠতে ইতস্তত করে।
শোভন প্রায় ধমকের সুরেই বলে, ভয় নেই, আমি ইরফান না, আমি শোভন চৌধুরী। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়ি, তোমার বান্ধবীর ভাই, বিশ্বাস করতে পার আমাকে।
মিথিলা চোখের পানি মুছে শোভনের বাইকে উঠে। শোভন বলে, চল, সোজা আমাদের বাসায় মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আজকের বিষয়টা ভুলে যাও।