
আলো-আঁধারির সন্ধিক্ষণে কোনো এক নিস্তব্ধ রাত শেষে পূর্ব আকাশ আলোকিত করে সূর্য ওঠার আগেই জীবনের প্রয়োজনে আপনজন ও প্রাণপ্রিয় দেশের সীমানা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম বিদেশে। ভাঙা বুকে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আকাশপথে দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা ধরে ওড়া শেষে পা রেখেছিলাম নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে। অচেনা দেশ, অচেনা মুখ, অচেনা চারপাশের পরিবেশে নিমজ্জিত আমি সেদিন বেদনায় লীন হয়ে চুপসে
পড়েছিলাম। বুকের ভেতর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আমার প্রিয় সোনাঝরা বাংলাদেশের স্মৃতির মিছিলের মর্মর ধ্বনি।
মানুষ পরিবর্তনশীল কথাটি যদিও সত্য তবুও পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া। তার চেয়েও কঠিন বিষয় নিজের মনের সঙ্গে একটু একটু করে যুদ্ধ করে নিজেকে বদলে ফেলা। ভাগ্যলিপির কাছে আজন্মলালিত আবেগ, অনুভূতিদের নীরবে সমর্পণ করে ভিনদেশের সংস্কৃতি, পোশাক, ভাষা, ঐতিহ্যের সঙ্গে পথ চলা শুরু করি সে অনেক বছর আগে।
নতুন শহরে আসার মাসখানেক পরেই শুরু হয়েছিল সিয়াম সাধনার পবিত্র মাস মাহে রমজান। এশিয়া মহাদেশ থেকে আমেরিকা মহাদেশ যে এত দূরে রমজানের প্রথম দিনেই তা অনুভব করেছিলাম। আমি যখন সাহরি খেয়ে ঘুমাতে যেতাম তখন আব্বা, আম্মা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইফতারের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। দেশে কথা বলার পর সবার মাঝে রোজা, ঈদের উৎসব মুখর পরিবেশ শুনে বুকের ভেতর হাহাকার করত। এখানে ঘড়ি দেখে একা একা আমি ইফতার করতাম, সাহরি খেতাম। রোজা, ঈদে কোথাও কোনো আমেজ দেখা যেত না।
সময়ের পরিক্রমায় এই শহরের অনেক কিছুই আজ পরিবর্তন হয়ে গেছে। বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনে যখন খোলা আকাশের নিচে সব দেশের, ধর্মের মানুষগুলো এক সঙ্গে বসে ইফতার করে আনন্দময় পরিবেশে তখন বুকে সুখের ঢেউ খেলে যায়। রোজার পুরো মাস জুড়ে প্রায় প্রতিদিন-ই বাঙালিরা পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ইফতার ও সাহরি খায়।
ঈদের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বাঙালি পাড়া নামে খ্যাত জ্যাকসন হাইটসে বাঙালিদের জামা-কাপড়, গহনাদি এবং মুদির দোকানগুলোতে চোখে পড়ার মতো ভিড় বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয় ঈদের আগের পুরো চাঁদ রাত জুড়ে চলে মেহেদি উৎসব। বিদেশের বুকে বাঙালিদের সুখের গল্পের উত্তরাধিকারী আমাদের সন্তানেরাও চাঁদ রাতে মেহেদির নজরকাড়া আলপনায় নিজেদের রাঙিয়ে তোলে। আবার ভোর হতেই বাবা, মায়ের হাত ধরে গোসল করে ঈদের নতুন জামায় নিজেদের সজ্জিত করে ঈদগাহের দিকে ছুটে যায় নামাজ পড়তে।
এ দেশে এসে অন্য অনেক বাঙালির মতো আমিও খাবারের কষ্টে ভুগেছি অনেক দিন। বিদেশের রেস্তোরাঁগুলো ভর্তি হরেক রকমের চোখ ধাঁধানো ফাস্ট ফুড খাবারে আমার মন বসত না। কোনো বিদেশি খাবার-ই আমার গলা দিয়ে যেন পেটে যেতে চাইত না। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাইরের রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেই আমার চোখ খুঁজে বেড়াতো দেশীয় আলু বা মাছের ভর্তা, ঘন ডাল, ডিম ভাজা, করলা ভাজা, আলু পটলের সঙ্গে চিংড়ি মাছ, মিহি নারিকেল বাটা দিয়ে পাবদা মাছের ঝোল, সরিষা ইলিশ, পাটের শাক, শাপলার সঙ্গে বুটের ডাল, পুঁইশাক ভাজি ইত্যাদি। বিধি বাম। বাসার আশপাশে কোনো বাঙালি মুদি দোকানও ছিল না তখন।
কোনো কথাই যেমন শেষ কথা নয় ঠিক তেমনি কোনো অবস্থান ও চিরস্থায়ী নয়। আজ এই শহরের প্রায় সর্বত্রই বাঙালি রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। বাঙালি খাবার খুবই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে বাঙালি মুদি দোকান। যেখানে খুব সহজেই দেশীয় শাকসবজি ও মাছ, মাংস পাওয়া যায়। বছরের যে কোনো বিশেষ দিনগুলোতে কিংবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাঙালি বেশির ভাগ পরিবারগুলোই তাদের সন্তান, আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে যান বাইরের বাঙালি রেস্তোরাঁয় নিজ দেশের খাবারের অমৃত স্বাদ আস্বাদন করতে।
বাঙালি যেমন উৎসব মুখর আমুদে জাতি ঠিক তেমনি ভোজন রসিকও। হাজার মাইল দূরে এসেও বাঙালি ভুলে যায়নি খেজুরের রসের পায়েস, নানান রকম পিঠা, পুলির কথা। শীত প্রধান শহর নিউইয়র্কে প্রায় বছর জুড়েই বাঙালি পিঠা উৎসব করে থাকে। পিঠা উৎসবগুলোতে বাংলাদেশের সব অঞ্চলের পিঠা পাওয়া যায়। সেখানে দিনভর বাঙালি অভিভাবকেরা তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দেশীয় কাপড়-চোপড় কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে থাকেন আনন্দে। রসনায় তৃপ্ত বাঙালিরা মাঝরাতে বাসায় ফেরেন।
কখনো সখনো সামান্য ব্যাপারটিও বুকের ভেতর অসামান্য হয়ে বাজে। প্রবাসীদের বুকের ভেতরে একটি শান্ত জলের পুকুর আছে। যে পুকুরের নিশ্চুপ জলে রাতদিন খেলা করে নিজ দেশের ভাষা, সুর, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি। বিদেশের প্রশস্ত হাইওয়ে ধরে সাই সাই করে ছুটে চলা গাড়ির ভেতরে হতে হঠাৎ যখন কানে ভেসে আসে শত শত বিদেশিদের গাড়িবহরের মাঝখানে ‘কেন পিরিতি বাড়াইলিরে বন্ধু ছাইড়া যাইবা যদি, আমি কেমনে রাখিব তোর মন আমার আপন ঘরে বাঁধিরে বন্ধু.... . ছেড়ে যাইবা যদি......।’ বিদেশের ইথারে যখন ভাসছে বাংলা ভাষায় গান ও বাংলাদেশের গর্ব শাহ্ আব্দুল করিমের গান! তখন যেন বুকের ভেতর ভালো লাগার গাছপালারা সবুজ পাতায় ভরে যায়। ভালোবাসার আদরে ছায়া দিয়ে যায় নীরবে। স্পেশালাইজড্ স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার কন্যার স্কুল থেকে যখন বাংলা ভাষায় কথা বলা ফোন কল পাই, এ দেশে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা স্কুলে পেরেন্ট-টিচার মিটিং-এ গেলে আমাকে বাংলায় স্বাগতম জানায় তখন আর মনে হয় না ইদানীং আমি বিদেশে আছি।
কথা কে আবিষ্কার করেছেন তা আমার জানা নেই। তবে কথা বলা ছাড়া মানুষ বাঁচতেই পারত না মনে হয়। মানুষ কথার মাধ্যমে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে। বাঙালি আড্ডা প্রিয় জাতি। প্রথম নিউইয়র্কে আসার পর বিদেশিদের ভাষা বুঝতাম না। আশপাশে তেমন কোনো বাঙালির দেখা পেতাম না। মনে পড়ে একদিন বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম বাঙালি খুঁজতে। তখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসত যেন কথা বলতে না পারার কষ্টে।
এখনকার চিত্র পুরো মাত্রায় ভিন্ন। এই শহরের আনাচে কানাচে বাঙালিদের পদচারণায় এখন মুখরিত। দেশীয় খাবারের দোকানগুলোতে বাঙালিরা সময় পেলেই চা-সিংগারা হাতে ঠিক দেশের মতন গল্প, আড্ডায় মেতে থাকে বিরামহীন ভাবে। ছুটির দিনে এই বাসায়, সেই বাসায় বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে হই হুল্লোড়ে মেতে উঠে।
নিউইয়র্ক শহরে মুভি থিয়েটারের বড় পর্দায় বাংলাদেশের ছবি দেখতে যায় বাঙালিরা সদলবলে। কেউ কেউ তাদের সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে যান। তারা বাংলাদেশের মন মাতানো সবুজ নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে দেশে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে বাবা, মায়ের কাছে।
বাঙালিরা পূর্ণ আধিপত্যে জীবন যাপন করছে নিউইয়র্কে। গ্রীষ্মকালীন স্কুল, কলেজ ছুটির দিনগুলোতে তারা সপরিবারে বন্ধুবান্ধব সহ বাস ভাড়া করে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিভিন্ন নামকরা বিখ্যাত পার্কগুলোতে বনভোজনে যায়। চড়ুইভাতির মতো পার্কের মধ্যেই তারা রান্নাবান্না করে আবার কেউ কেউ খাবার সঙ্গে নিয়ে যায়। দেশের গান, খাবার, খেলাধুলায় বাবা, মায়েরা সন্তানদের সঙ্গে পুরোদিন কাটিয়ে সূর্যাস্তের পরে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে।
মনে আছে এই শহরে প্রথম যেদিন শাড়ি পরে খোলা চুলে রাস্তায় হাঁটছিলাম বিদেশিরা তখন হা করে তাকিয়ে ছিল। কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেছিল। নিজেকে সেদিন কেমন অন্য গ্রহের মানুষ মনে হয়েছিল।
অথচ, আজ যখন বাঙালি নারীরা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে খোলা চুলে রং বেরঙের ফুল গুঁজে হাতে একতারা, পালকি, কলস, হাতপাখা, রিকশাসহ বাঙালিদের নানান ঐতিহ্য বহনকারী বিভিন্ন ফেস্টুন হাতে নিয়ে পয়লা বৈশাখে রাস্তায় র্যালিতে যোগ দেয় তখন চোখের বিল ভরে যায় আনন্দ অশ্রুতে। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে পুরো বিশ্বের মানুষ প্রজাতি বিস্ময় ভরা চোখে উপভোগ করে বাঙালি জাতির সমৃদ্ধিশালী সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। আমাদের সন্তানেরাও তাদের বাবা, মায়ের সঙ্গে নানান রকম দেশীয় পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবা, মায়ের সঙ্গে পান্তা ইলিশ খায়। নতুন প্রজন্মের মেধাবী, উৎসুক বাঙালি ছেলে-মেয়েরা বাবা, মায়ের থেকে জেনে নেয় পান্তা, ইলিশ কেন খায় ও তার ইতিহাস। আরও সুখের বিষয় হলো, নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে ও মিশে দেখলাম তাদের বেশির ভাগ-ই জানে বাংলাদেশের জাতীয় ফল, ফুল, মাছ সম্পর্কে।
বিদেশের মাটিতে বাঙালি মেলায় যখন দেখি বিদেশিরা শাড়ি পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে তখন বুকের ভেতর সুখে কাঁপন ধরে। অন্য রকম এক আনন্দের ঘোর লাগা ভেলায় ভাসতে থাকি। হাজার হাজার ভাষার ভিড়ে চলতি পথে যখন দেখি ট্রেনে বাংলা ভাষার পোস্টার তখন বাংলাদেশি হিসেবে গর্বে মন ভরে যায়। নিউইয়র্কের ভোটকেন্দ্রে বাংলা ভাষায় নির্দেশনা ও ব্যালট পেপার বাংলা ভাষা ভাষীদের বিশ্বের বুকে মর্যাদায় আসীন করেছে। প্রাণ ভরে অবাক বিস্ময়ে দেখি বিদেশে জন্ম নেওয়া আমাদের সন্তানদের মঞ্চে বাংলা গান পরিবেশন, আবৃত্তি, অভিনয় ও নৃত্য। নতুন প্রজন্মের বাঙালি ছেলে-মেয়েদের জন্য এই শহরে অনেকগুলো বাংলা স্কুল গড়ে তুলেছেন অভিভাবকেরা যেখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শুদ্ধ চর্চা করানো হয়।
২১-শে ফেব্রুয়ারির খুব প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চারা খালি পায়ে ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফুল হাতে যখন শহীদ মিনারের দিকে হেঁটে যায় তখন সে দৃশ্য হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয় এই বিদেশের মাটিতে। ২৬-শে মার্চ, ১৬-ই ডিসেম্বর সহ বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক প্রতিটি দিন-ই যথাযোগ্য মর্যাদায় বাবা, মায়েরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পালন করেন। বিদেশে জন্ম, বেড়ে ওঠা হলেও বাঙালি ছেলে মেয়েরা নিজ দেশের সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে মনেপ্রাণে ধারণ করে ও ভালোবাসে।
জগতের সব ঘটনা মানুষের মনের মতো করে ঘটে না। নিয়তির কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় মানুষকে প্রতিনিয়ত শৃঙ্খলিত হতে হয়। শৃঙ্খল কখনো মধুর কখনো তা বেদনা বিধুর। অনেক বছর আগে বিদেশের যে সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাক, ঐতিহ্যের শিকলে আটকা পড়েছিলাম নীরবে, আজ যখন নিজ দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পোশাক, ভাষার আধিপত্য দেখি চারপাশে তখন ভাঙা বুক আমার ভরে যায় পূর্ণতায় এই দূরদেশে।