ভূত মারুফ, মানুষ মারুফ

সোম থেকে শুক্র, স্কুলের দিনগুলি একইরকম। দশটা থেকে চারটা, ছয়টি ঘণ্টা ক্লাস। মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি, টিফিন খেয়ে বোমাকিং কিংবা কিংকং খেলা। শনিবার অর্ধবেলা স্কুল শেষে ফিরে লম্বা দুপুরের ভাতঘুম। ব্যতিক্রম রোববার। এই একটি দিন তারা দুই ভাই আর বন্ধুদের নিজেদের মতো কাটানোর একটু স্বাধীনতা। গত রোববার তারা সাহস করে মোড়ের দোকান পর্যন্ত গিয়ে বলগাম কিনেছিল। কারও বাড়িতে কেউ কিছু জানতে পারেনি, সেই সাহসে আজ রোববার আবার তারা একত্রিত হয়। চুন্নু বলে, “আমার কাছে পয়সা আছে। চল, বল গাম কিনি।” সবাই খুশি। দোকান থেকে ফিরে গাম চিবোতে চিবোতে প্ল্যান করে আজ তারা কী করবে। হঠাৎ মারুফের মনে পড়ে ডানদিকের রাস্তায় কোনো দিন যাওয়া হয় না। বাবার নিষেধ, মার বারণ ওদিকে যাওয়া যাবে না। কেন বারণ, জানেন না সে। আজ তার জিদ চাপে মনে। প্রস্তাব করে, “চল, আজ আমরা ওদিকে যাব। চুন্নু মিন মিন করে, “ওদিকে আমাদের যাওয়া নিষেধ । বাবা জানতে পারলে—“! মুন্না বলে, ভিতুর ডিম, তুই থাক, আমরা যাব”।সবাই পা বাড়ায়। অগত্যা চুন্নুও সঙ্গী হয়।
সেই হলো বিপত্তির শুরু। মারুফের স্বাভাবিক জীবন ধারায় বিঘ্ন ঘটার সেই দিনটি ছিল প্রারম্ভিকা। মারুফদের ছোট্ট দলটি এগোচ্ছে সামনে। ক’টি মাত্র বাড়ি পেরোনোর পরেই চারদিকে উঁচু প্রাচীর বেষ্টিত বিশাল জায়গা জুড়ে একতলা একটি দালান। বাইরে থেকে দেখা যায় একদিক জুড়ে অনেকগুলি উঁচু গাছ আকাশ পানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। দুই তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে বাগানের এপারে উত্তর দক্ষিণ সমান্তরাল দু’সারি সুপারি গাছের মাঝ বরাবর ইট সুরকি বিছানো পথ। উত্তরে যেখানে পথটা এসে মিলেছে পৌর সড়কে, সেখানে সীমানা নির্ধারক প্রাচীরটি দ্বিধাবিভক্ত লৌহশলাকা যুক্ত ইস্পাত পাতে মোড়া দুই পাল্লার দরজা দিয়ে। দরজার ফাঁক দিয়ে বাড়িটির ভেতরের অনেকটা দেখা যায়। সেই ফাঁক দিয়ে কিশোরদের কৌতূহলী চোখ ভেতরটা দেখে নেয়। তারা দেখে পূর্ব দিকে আম, জাম, কাঁঠাল গাছগুলোর ফাঁকে একটা ঘাট বাঁধানো পুকুর আছে। আর সুরকি বিছানো পথের মাঝ বরাবর পশ্চিম ঘেঁষে একটি লিচু গাছ। গাছটির হাত পনেরো পরে মূল বাসগৃহ। বাড়িটির গায়ে কেমন শ্যাওলাটে ক্ষত। ভেতর থেকে বাতাসে ভাসছে কেমন উৎকট বনজ গন্ধ। অস্বাভাবিক রকমের সুনসান শান্ত নীরব। যেন পুরোনো দিনের গন্ধ গায়ে কালের সাক্ষী হয়ে নীরব দুঃখ বুকে কেঁদে ফিরছে দালান বাড়িটি। বাড়িটির হাল কিশোরদের মনে রূপকথার গল্পের রোমাঞ্চ এনে দেওয়ার কথা। মনে ভাসবার কথা সোনার খাটে ঘুমন্ত বন্দী রাজকন্যার কথা। কিন্তু তাদের সেসব কিছুই মনে আসছে না। কেমন যেন শিরশির করা এক ভয় তাদের মনে বসে যাচ্ছে। পালানোর তাড়না বোধ করছে। সবচেয়ে ভয় ওই লিচু গাছটাকে। গাছটির চেহারা, আকার ঝাঁকড়া ডাল পাতার গঠন, অবস্থান কোনো কিছুই স্বাভাবিক নয় যেন! তাকালেই গা ছমছম করে। তারা পালাতে চায়। কিন্তু মারুফ, তার যেন সংবিৎ নেই। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে গাছটির দিকে। মুখে এই হাসি, পরক্ষণেই বিষাদ কালি মাখা। একটু পর পর মনে হচ্ছে সে বিড বিড করে গাছের সঙ্গে কথা বলছে। বন্ধুর দল বিচলিত বোধ করে। তারা মারুফকে জোর করে ধরে ওখান থেকে বাসায় পৌঁছে দেয়। সমস্ত দিন সে গম্ভীর হয়ে থাকে। মা বা ভাইয়ে সঙ্গে কথা বলে না। তাদের ডাকেও সে সাড়া দেয়নি। বিকেল বেলা বাবাও অনেক চেষ্টা করে তার কাছ থেকে কিছু জানতে পারেননি। ঠিক মাগরিবের আজান হওয়ার পর পরই মারুফের গা কাঁপিয়ে জ্বর এল। রাতে কিছুই খাওয়ানো গেল না। মারুফের বাবা পারিবারিক ডাক্তার জহির সাহেবের শরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার সব শুনে তাঁকে আশ্বস্ত করে তখনকার দিনের অবধারিত ওষুধ দাগ কাটা মিকশ্চার দিলেন। এক দাগ খাওয়ানোর পর জ্বর একটু কমল বটে, রাতে শুরু হলো শরীর কাঁপুনি। সঙ্গে ভুল বকা আর খিঁচুনি। সারা রাত স্বামী-স্ত্রী দুজন ছেলের শিয়রে বসে জেগে রইলেন। যা করার মারুফের বাবাই করলেন। মারুফের মা কেঁদে কেটে আর দোয়া পড়ে রাত কাটালেন। ভোরের আজান পড়ার পর মারুফ শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বাবা থার্মোমিটারে জ্বর মাপলেন। জ্বর ছেড়ে গেছে। মারুফের গা ঘামছে। বাবা কম্বল সরিয়ে দিলেন। সন্তর্পণে গা স্পন্‌জ করে দিলেন। সকাল দশটার দিকে মারুফের ঘুম ভাঙে। তখন সে স্বাভাবিক। বাবা ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার আগে মাকে বলে গেলেন তিনি যেন পল্টু চুন্নুদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেন গতকাল এক্সাক্টলি কী ঘটেছিল।
বাবা বিকেলে ফিরে আসার পর মায়ের কাছে সব শুনে বিচলিত হলেন। ভাবতে লাগলেন কী করা যায়?
সেদিন মারুফ বাসাতেই ছিল সারা দিন। পরদিন স্কুলে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই দিনটি পার হলো। বিপত্তি হলো এর পরদিন। স্কুল থেকে ফেরার পথে সে রিকশাওয়ালা চাচাকে রিকশা নিয়ে ওই লিচুগাছ বাড়ির রাস্তা দিয়ে যেতে বলে ।
রিকশাচালক ভদ্রলোক কিছুতেই তার কথা না শুনে আগের মতোই ঘুর পথে বাসায় নিয়ে আসে। বাসার সামনের মোড়ে এসে মারুফ রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে ওই বাড়ির দিকে ছুটে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রিকশা চালক রিকশাসহ তার পিছু নিয়ে গিয়ে দেখেন সে ততক্ষণে ওই বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লিচু গাছটির দিকে সম্মোহিতের মতো পলকহীন তাকিয়ে আছে। মুখে তার এক চিলতে ক্লিষ্ট হাসি। তিনি জোর করে পাঁজাকোলা করে মারুফকে রিকশায় বসিয়ে বাসায় এনে মেমসাহেবকে ডেকে সব বলে যান। মারুফ তখন রিকশা চালক ভদ্রলোককে চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে যেন, এমন ক্রোধের আগুন জ্বলছিল মারুফের চোখে। মারুফের মুখের ওই বিকৃতি ও চোখের আগুন তার মায়ের অন্তর কাঁপিয়ে দেয়। সব শুনে মারুফের বাবা গম্ভীর হয়ে যান। বাসা বদলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
দুদিন ঠিকভাবে যায়। তৃতীয় দিনে ঘটে অস্বাভাবিক অবিশ্বাস্য এক রোমহর্ষক ঘটনা। রিকশা চালক দবিরুদ্দীন স্কুল শেষে মারুফকে বাসায় নেওয়ার জন্য স্কুলের গেটে বসে আছেন অনেকক্ষণ। এক এক করে সব ছাত্র বেরিয়ে এল। মারুফ এল না। দবিরুদ্দীন ভয় পেয়ে গেলেন।
রিকশা সামনে স্ট্যান্ডে একজনকে দেখতে বলে তিনি স্কুলে ঢুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও না পেয়ে অস্থির হয়ে গেলেন। একে তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন পূর্ব দিকের ছোট দরজা দিয়ে তাকে বের হতে দেখা গেছে। তিনি বুঝে গেলেন যা বোঝার। তাড়া তাড়ি তিনি রিকশা নিয়ে ছুটলেন মারুফদের বাসার দিকে। যা ভেবেছিলেন, ঠিক তাই। ওইতো মানুষকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মারুফ অমন তাড়া খাওয়া মানুষের মতো ছুটছে কেন ? সে ওই লিচু গাছ বাড়ির সামনে নয়। পার হয়ে ছুটছে নিজেদের বাড়ির দিকে। তিনি চিৎকার করে ডাকছেন, কিন্তু সে কিছুই শুনছে না। রাস্তায় কোনো মানুষও নেই যে তাকে আটকাতে বলবেন। তিনি তাড়াতাড়ি রিকশা চালিয়ে গিয়ে তাকে ধরলেন। সে তার কোলে নেতিয়ে পড়ল যেন! তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে গিয়ে মেমসাহেবকে ডেকে মানুষকে ধরাধরি করে শুইয়ে দিলেন। মা তাকে নরম ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ হাত মুছিয়ে দিলেন। গলা ঘাড় মুছতে গিয়ে তিনি ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। ঘাড়ে আঙুলের নীলচে দাগ। কেউ তার গলা চেপে ধরেছিল। দাগগুলো মানুষের আঙুলের, কিন্তু যেন মানুষের নয়। মাংসবিহীন খালি হাড়গুলো দিয়ে চেপে ধরা হয়েছিল গলা। কেউ মারুফকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, যে মানুষ, অথচ মানুষ নয়। মারুফের মা ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলেন। দবিরুদ্দীন তাড়াতাড়ি ছুটলেন পারিবারিক ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনতে। ডাক্তার সাহেব গলার ক্ষত পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন। পানি ও পরে গরম দুধ খাইয়ে দিলেন। মারুফ এখন অনেকটা পরিশ্রান্ত অথচ শান্ত বালকের মতো ঘুমোচ্ছে। ততক্ষণে মারুফের বাবা এসে বাসায় ডাক্তার দেখে উদ্বিগ্ন মুখে ডাক্তারের দিকে তাকাতেই ডাক্তার ইশারায় তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। বললেন সব খুলে। অস্থির হতে বারণ করলেন। কয়েকটা পেইন কিলার ট্যাবলেট দিলেন ব্যাগ থেকে বের করে। একটা নাম ঠিকানা লিখে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, “ইনি একজন সাইকোলজিস্ট। এখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করুন এবং তাঁর পরামর্শ শুনুন।” তখনই ছুটলেন মারুফের বাবা।
ডাক্তার সব শুনে রিলাকজেন ট্যাবলেট লিখলেন, আর বাড়ি বদলাতে বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ঠিক সাত দিনের মাথায় বাসা বদল করা গেল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো বর্তমান বাসা থেকে মাইলখানিক দূরে, শহরের অভিজাত মহল্লা জলেশ্বরীতলায়। এটি দ্বিতল বাসা এবং বিদ্যুৎ আছে।
মারুফের বাবা স্বস্তিবোধ করলেও মারুফ কেমন যেন ফ্যাকাশে, চুপচাপ হয়ে গেল। স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য দবিরুদ্দীনের সঙ্গে একজন লোক দিলেন মারুফের বাবা। সেই লোককে সহ্য করতে পারত না মারুফ। রাগারাগি করত। ঘটনাটি ঘটল নতুন বাসায় আসায় পাঁচ দিনের মাথায়। স্কুলের দপ্তরি আর একজন শিক্ষক খোঁজ করে নতুন বাসায় এসে জানান দিলেন স্কুল থেকে হঠাৎ মারুফ নিখোঁজ হয়ে গেছে। তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। মারুফের মা তাড়াতাড়ি রিকশা ডেকে ওঁদেরকে নিয়েই গেলেন তাঁদের আগের বাসার ওখানে ওই লিচু গাছওয়ালা বাড়িতে। আশঙ্কা সত্য। বড় গেটটার একপাশে নরম মাটির ওপর কাঁচুমাচু শুয়ে আছে মারুফ। কাছে গিয়ে জানা গেল সে জ্ঞানহীন। তাকে ধরাধরি করে হাসপাতাল নেওয়া হলো এবং মারুফের বাবাকে খবর দেওয়া হলো। তিন দিন পরে মারুফকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নেওয়া হলো। মারুফ একেবারে বিভ্রান্ত, উদ্‌ভ্রান্তের মতো। ওজন কমে গেছে অনেকটা। ফ্যাকাশে, হলদেটে দেখাত তাকে। বাবা সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়ে সব বললেন। এবারও তার গলায় মাংসবিহীন আঙুলের চেপে ধরা নীল দাগ ছিল, তাও বললেন। ডাক্তার পাশের ঘরে তাঁকে বসতে বললেন।
আরও দুজন রোগী ছিলেন, তাঁদের দেখে ডাক্তার তাঁকে নিজে এসে ডেকে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ কেউই কথা বললেন না। ডাক্তার যেন ভাবনার রাজ্যে চলে গেছেন। মারুফের বাবা আর নিতে পারছিলেন না এই চাপ। ছেলের ভাবনায় তিনি মুষড়ে পড়েছেন। কিন্তু বাসায় বুঝতে দেন না। মারুফের মা দিনরাত কান্নাকাটি করেন। মাসুকটাও জানি কেমন হয়ে যাচ্ছে। তাঁর গলা বুঁজে আসে। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। হঠাৎ ডাক্তারের ডাকে সংবিৎ ফিরে পান। ডাক্তার বলেন, “আচ্ছা বদরুল সাহেব (মারুফের বাবার নাম বদরুল হাসান), আপনার ফ্যামিলি ঢাকায় শিফট্ করতে পারেন? আপনার সে ব্যবস্থা আছে? আমার মনে হচ্ছে ঢাকায় থাকলে আপনার ছেলে এখানকার এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। পেছনের এই সব কথা, ঘটনার ছাপ মুছে যাবে। সে সুস্থ জীবন যাপন করবে।” বদরুল সাহেবও কথাটা ভেবেছেন। উত্তর কাটনারপাডা এবং জলেশ্বরীতলা দু’ জায়গাতেই বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে। পাড়া পড়শিরা এই নিয়ে খুব উৎপাত করে। বিষয়টি বিব্রতকর। তিনি বললেন, “জি পারব, আমার বড় ভাই ঢাকায় হাতিরপুলে থাকেন। আমার অসুবিধা হবে। এখানে ফ্যাক্টরিটা আমাকেই দেখতে হয়! তবু আমি ছেলের ভালোর জন্য তাই করব।” ডাক্তার তাঁকে সাহস যুগিয়ে, ছেলের রোগমুক্তির দোয়া জানিয়ে বিদায় দিলেন।
মারুফের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। সে বাসাতেই থাকে। তাকে চোখে চোখে রাখা হয়। সাত দিনের মাথায় ঢাকা রওনা হয় তারা। প্রথম কয়েক দিন মারুফ একেবারে চুপচাপ থাকে। তারপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয়। বাড়ি ভরা মানুষ। বড় চাচা সব সময় খোঁজখবর করেন। এর মধ্যেই চাচাতো ভাইবোন সহ মারুফকে বড় চাচা জাদুঘর, চিড়িয়াখানা দেখিয়ে এনেছেন। সন্ধ্যার পর ছাদে দাঁড়িয়ে মারুফ নিয়ন আলোর দৌড় দেখতে পায়। শেরাটন হোটেলের আলোকসজ্জা দেখে দাঁড়িয়ে। সে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বাবা এসে দুই ভাইকেই এখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। মারুফ পুরোপুরি সুস্থ। বছরখানেক বাদে জানুয়ারীর শুরুতে মারুফের বাবা এসে জানান তিনি ফ্যাক্টরির কাছাকাছি, শহরের পশ্চিম উপকণ্ঠে নিজেদের যে বাড়ি বানাচ্ছিলেন, তার কাজ শেষ। তাঁরা আগামী সপ্তাহে সে বাড়িতে উঠবেন। কথাটা শুনে দু’ভাইই মন মরা। তারা ঢাকায় থাকতে চায়। পরের রোববার তারা বগুড়ায় নতুন বাড়িতে ওঠে। সোমবার বাসায় মিলাদ মাহফিল হয়। দোয়া করানো হয়। মারুফের সঙ্গে এবার মাসুকও স্কুলে যেতে শুরু করে। সবকিছু স্বাভাবিক। মারুফের মা-বাবার দুশ্চিন্তা দূর হয়। এক মাস পর একদিন দুপুর ২:৪০ মিনিটে হঠাৎ স্কুল থেকে দপ্তরি হরিপদ, করণিক রফিক সাহেবসহ বাসায় এসে মারুফের বাবাকে সংবাদ দিতে বলে তাঁদের মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালে আসতে বলেন। জানান, সেখানে জেনারেল ওয়ার্ডে মারুফকে ভর্তি করা হয়েছে। শুনেই মারুফের মা কান্না জুড়ে দেন। মারুফের বাবাকে তাদের ঢাকা থেকে নিয়ে আসার জন্য দোষারোপ করে বিলাপ করতে থাকেন। তিনি তৈরি হয়ে নিয়ে মারুফের বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে এসে সব জানতে পান মারুফের ক্লাস টিচারের মুখে। তিনিই হাসপাতালের সব ব্যবস্থা করে মারুফের পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিলেন। তাঁর মুখে শোনেন মারুফ আজ আবার টিফিন পিরিয়ডে বের হয়ে ওই বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পরের ক্লাসে তাকে না পেয়ে বিচলিত স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে খুঁজতে ওই বাড়ির দিকে হরিপদ ও সামসুকে পাঠালে তারা গিয়ে লিচু বাড়ির গেটের পাশে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে স্কুলে সংবাদ জানিয়ে প্রধান শিক্ষক সাহেবের নির্দেশ মতো হাসপাতালে ভর্তি করান। তার গলায় এবারও আগের মতো নীল দাগ ছিল। ববদরুল সাহেব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ছেলেকে কেবিনে ট্রান্সফার করায়। কর্তব্যরত ডাক্তার জানায় এখন সে বিপদমুক্ত। তবে ক’দিন তাকে হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
চার দিন পর হাসপাতাল থেকে মারুফকে বাসায় এনে তাকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করার লোক ঠিক করেই বদরুল সাহেব ঢাকায় গিয়ে দেশের সেরা সাইকোথেরাপিষ্ট নাজমুদ্দৌলা চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তাঁকে সব খুলে বলেন। উনি প্রশ্ন করলেন, “ওই বাড়িতে কোনো শিশুর অপমৃত্যু হয়েছিল কিনা?” মারুফের বাবা বললেন তিনি জানেন না। অধ্যাপক চৌধুরী আবার প্রশ্ন করেন, “আপনি কেন আপনার ছেলেকে ওই বাড়ির দিকে যেতে নিষেধ করেছিলেন?” বদরুল সাহেব জানান, তাঁর পরিচিত কাস্টমস এ্যান্ড এক্সাইজে কর্মরত সেলিম সাহেবের করাচি পোস্টিং হলে তিনি সপরিবারে করাচি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বদরুল সাহেব বাসাটি ভাড়া নেওয়ার পর ওই বাসায় এলে প্রতিবেশী বাড়িগুলোর নারীরা মারুফের মাকে জানায় তারা তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে বাগান পুকুর ওয়ালা ওই বাড়ির দিকে যেতে দেন না। ওই বাড়িতে নাকি ভূত আছে। রাতে কান্নার শব্দ পাওয়া যায়। মারুফের মায়ের কাছ থেকে বিষয়টি জানার পর থেকে তিনি মারুফকে ওইদিকে যেতে বারণ করে দেন। সব শুনে উনি জিজ্ঞেস করেন, “ওই বাড়িতে মানুষ বাস করেন?” মারুফের বাবা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লে তিনি তাঁকে বলেন, “আপনি বগুড়া যান। ওই বাসায় গিয়ে ওদের কাছ থেকে ওবাড়ির ডিটেইলস জেনে আসবেন। বিশেষ করে বাড়িটিতে কোনো অপমৃত্যু ঘটেছিল কিনা ? কীভাবে ঘটেছিল?”
পরদিন বদরুল সাহেব বগুড়া ফিরে যান এবং সেদিনই সন্ধ্যার পর তার বন্ধু অধ্যাপক আলী আকবর সাহেবকে নিয়ে ওবাড়িতে গিয়ে গৃহস্বামীর সঙ্গে দেখা করেন। ভদ্রলোক পূর্ব পরিচিত। এক এলাকায় থাকার সুবাদে বার তিনেক দেখা সাক্ষাৎ ঘটেছে। আলাপ কথা হয়েছে সামান্যই। সব শুনে তিনি খুব কষ্ট পেলেন। সহানুভূতি জানালেন। ভেতরে চা পাঠানোর কথা বলে এসে মুখোমুখি বসে একটু সময় নিয়ে ধীর গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করলেন, “বাড়িটা বানিয়েছিলেন আমার বড় ভাই। আমি ও আমার বোনও তাঁর সঙ্গে এ বাড়িতেই থাকতাম। বিয়ে হওয়ার পর বোন শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। ভাই-ভাবি’র একমাত্র ছেলেটার বয়স সাত বছর। আমি বছর খানিক আগে বিয়ে করেছি। এ সময় একদিন বাড়ির কাজের ছেলের সহযোগিতায় ও লিচু গাছে চড়ে বসে। গাছটা তখন এত বড় ছিল না। আর ডালগুলোও নিচু ছিল। কাজের ছেলেটি বকা খাওয়ার ভয়ে ওকে নেমে পড়ার তাগাদা দিচ্ছিল বারবার। তাড়াহুড়োয় নামতে গিয়ে গাছ থেকে সে নিচের বড় গর্তে পড়ে যায়। গর্তে থাকা কন্সট্রাকশনের একটা বড় রড সিমেন্ট খোয়ার চাঁইয়ের সঙ্গে মাথা থেতলে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ বাড়ির ওই লিচু তলাতেই তাকে গোসল ও দাফন–কাফন করা হয়। পরে নামাজগড কবরস্থানে তাকে কবর দেওয়া হয়। ভাবি এ ঘটনার পর একেবারেই ভেঙে পড়েন। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতেন। মাঝে মাঝে মূর্ছা যেতেন। আচরণ করতেন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো। রাতে মাঝে মাঝে ছেলের কান্না শুনতে পান বলতেন। ভাইজানও খুব হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। ভাবির কথা চিন্তা করে উনি চেষ্টা করে চাকরি নিয়ে জার্মান চলে যান। দেশে আর ফেরেননি।”
উনি চুপ করে গেলেন। বদরুল সাহেব ছেলেটির নাম জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন, “ওর নাম রেখেছিল ওর দাদু। মারুফ। মারুফ হাসান।” কেউ যেন বদরুল হাসান সাহেবকে পীঠে চাবুক কষালেন, ওটি তার ছেলের নাম। তিনি ত্বরিত জিজ্ঞেস করেন ওর জন্ম তারিখ জানেন? উনি বলেন, “হ্যাঁ, জন্ম তারিখ ২২ শ্রাবণ, ১৩৭০ সাল।”
এবার বদরুল সাহেব চমকে চেয়ার থেকে পড়ে যেতে নিতেই তাঁর বন্ধু তাঁকে ধরে ফেলেন। তাঁর দম বন্ধ বন্ধ লাগে। অথচ ঘরের দরজা জানালা খোলা। পর্দা সরানো। মাথার ওপর ফ্যান আস্তে করে ঘুরছে। দরজা জানালা পথে আসা শিরশিরানি বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা মাছের আঁশটে গন্ধ পান যেন। তাঁর গা গুলিয়ে ওঠে। মনে পড়ে তাঁর মারুফের জন্মের দিনের কথা। ২২ শ্রাবণ, ১৩৭৭ সাল। সেদিনের হাসপাতালের স্মৃতি মনে ভাসে। হইচই হট্টগোল শুনে বাইরে এসে দেখেছিলেন অনেক মানুষের জটলা। তার মাঝেই কান্না কাটি বিলাপ। শুনেছিলেন একটা সাত বছরের ফুটফুটে সুন্দর ছেলে লিচু গাছ থেকে পড়ে মারা গেছে। তিনি তড়িঘড়ি ওয়ালেট থেকে ছেলের ছবি বের করে ভদ্রলোকের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি দেখে চমকে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বললেন, “এটাতো আমাদের মারুফের ছবি, আপনি কোথায় পেলেন?” মারুফের বাবা অস্ফুটে বললেন, এটা আমার ছেলে মারুফের ছবি।” ভদ্রলোক বিস্ময়ে বিমূঢ়। তিনি কিছুই যেন বুঝতে পারছেন না। ভদ্রলোককে ওই অবস্থায় রেখে তাঁরা বেরিয়ে এলেন। রাস্তায় নেমে পিছু ফিরে একবার লিচু গাছটার দিকে তাকালেন। মনে হলো গাছের একটা অংশ যেন নাড়া দিয়ে সরে গেল কেউ। নাকি সবই মনের ভুল? টলতে টলতে বন্ধুর সহায়তায় বাড়ি ফিরলেন। বাসায় কাউকে কিছু বললেন না। খেলেন না কিছুই। হাত মুখে পানি দিয়ে এসে শুয়ে পড়লেন।
সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে রওনা হলেন ঢাকার উদ্দেশে। বিকেলে পৌঁছে বাসায় গিয়ে ফোন করলেন অধ্যাপক নাজিমুদ্দৌলাকে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেন তাঁর। অধ্যাপক পরদিন বিকেলের কথা বললেন। তিনি আজকেই তাঁর সাক্ষাতের অনুরোধ করায় উনি তাঁর মনের অবস্থা বিবেচনা করে সেদিনই রাত ন’টায় তাঁর বাসার চেম্বারে আসতে বললেন। হাতিরপুল থেকে সেগুনবাগিচা। তিনি বাসার গাড়ি করেই গেলেন। আগে আগেই এসে তাঁর চেম্বারে বসে রইলেন। ঘড়ির কাঁটা ধরে ডাক্তার চেম্বারে এলেন। তাঁকে ডেকে পাঠালেন। ভেতরে যেতেই চা অফার করলেন। উনি বিনয়ের সঙ্গে না করলেন।
অধ্যাপক সাহেব একটু সময় নিলেন। শেলফ থেকে ক’টি বই নামিয়ে বসলেন। সরাসরি তাকালেন মারুফের বাবার দিকে। প্রশ্ন করলেন, “আপনার ছেলে কেমন আছে? আপনি ও বাসায় গিয়েছিলেন?” তিনি মাথা নামিয়ে হ্যাঁ বলে পানি খেতে চাইলেন। পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে তিনি তাঁর গত রাতের অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে বললেন।
অধ্যাপক সাহেব গুম হয়ে রইলেন। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ ভাবলেন। কিছুক্ষণ বই ঘাটলেন। তারপর মারুফের বাবার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের ভঙ্গিতে বললেন, “সরি, বদরুল সাহেব, আমি খুব অসহায় বোধ করছি। চিকিৎসা শাস্ত্রে আমি আমার সমস্ত অর্জিত জ্ঞান একত্র করেও এক মারুফের অপঘাত মৃত্যু, আরেক মারুফের জন্ম, এক মারুফের ভূত কর্তৃক আরেক মারুফের আক্রান্ত হওয়া, এসবের কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারছি না। দুটো ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক নিরূপণে আমি অপারগ।” তারপর কিছুক্ষণ চোখ বুজে, মাথা নিচু করে যখন চোখ খুললেন, তখন তাঁর দুই চোখের কোণে পানি। ধরা গলায় বললেন, “অসুবিধা হলেও আপনি আপনার ফ্যামিলিকে ঢাকায় নিয়ে আসুন। আশা করি ঢাকায় থাকলে ও আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।”
মারুফের বাবা খুব অসুস্থ, ভেঙে পড়া অসহায় মানুষের মতো ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে এগোলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান সঙ্গে নিয়ে এক অসহায় চিকিৎসক বাৎসল্য ভরা এক অসহায় পিতার গমন পথের দিকে চেয়ে রইলেন কেবল!