আজ বহুদিন পরে খই দেখে একা একাই প্রচণ্ড জোরে হেসে উঠলাম। ছেলে যতই হাসির কারণ জানতে চায়, আমার ততই হাসি পায়। শেষে সব শুনে ছেলেও হেসে উঠল। হাসির কারণ শুনে পাঠকের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা অবশ্য জানি না। খইয়ের ঘটনাটা অবশ্য আজকের লেখার দ্বিতীয় ইস্যু হিসেবে সামনে আসবে। তার আগে অন্য একটি বিষয় নিয়ে লিখব। আমি বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছি। এবারের লেখা সেই প্রসঙ্গে।
প্রথম মরতে বসেছিলাম আঁতুড় ঘরে, জন্মের সময়ে। চতুর্থ সন্তান কন্যা হওয়ায় দাদি নবজাতকের নাড়ি না কেটেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। মা তখন সে অবস্থাতেই ছোট বোনের সহায়তায় আমার নাড়ি কাটেন। দীর্ঘ সময় রক্ত ও পানির মধ্যে পড়ে থেকে আমার নিউমোনিয়া হয়ে যায়। এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ভাবখানা এমন, তিন মেয়ে তো রয়েছেই, চতুর্থজন মরলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু শত অবহেলা, বঞ্চনার শিকার এই প্রায় মৃত ঘোষিত বাচ্চাটিও চিকিৎসকের চেষ্টায় আল্লাহর রহমতে ফিরে আসে জীবনে। প্রথম যাত্রায় রক্ষা!
আব্বা প্রতি কোরবানির ঈদে আমাদের নিয়ে দাদাবাড়ি নড়াইলের মাই গ্রামে ঈদ করতে যেতেন। আমি তখন ছোট ও বইপোকা। যেকোনো একটা রংবেরঙের বই হাতে পেলে সারা পৃথিবী থেকে নিজেকে অনায়াসে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতাম। সেবার ঈদ হয়েছিল বর্ষাকালে। তো এক বর্ষার দিনে দাদার কাছারি ঘরে আমি নতুন একটি ঝকঝকে বই হাতে পেয়ে যারপরনাই খুশি। এদিকে বড় বোনেরা কয়েকবার ডেকে গেছে ঢেঁকি ঘরে যেতে, খই খেতে। কিন্তু নতুন বই পড়ার আনন্দে এত মশগুল যে, সেই ডাক আমার কানে ঢুকছে না। তা ছাড়া আমি কেঁচো খুব ভয় পেতাম। বৃষ্টির দিনে দাদাবাড়ির উঠোনে কেঁচো থাকত, সেই কারণেও আমি উঠোন মাড়িয়ে অন্য ঘরে যেতে চাইতাম না। যা হোক, কেউ একজন আমাকে বাটি ভরে গরম খই ও গুড় এনে দেয়। এর পরেরটুকু ইতিহাস!
আমি তো বইয়ে ডুবে আছি, আর বাটি থেকে খই খাচ্ছি না তাকিয়েই। কিন্তু খইয়ের মধ্যে থাকা ধান প্রচণ্ড।ড বিরক্ত করছিল। তা ছাড়া ধান ফেলার জন্য কেউ আমাকে আরেকটি পাত্রও দিয়ে যায়নি। দাদার কাছারি ঘরে ছিল বিশাল এক খাট, এত বড় যে, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হতো। সেখানে বসেই দাদা বৈঠক চালাতেন। আমি সেই খাটে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম। আমার পক্ষে পড়া বন্ধ করে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ধান ফেলার জন্য কোনো পাত্র আনার চেয়ে নিজের কানে ধান গুঁজে রাখাটা সহজ ছিল। আমি তা-ই করলাম। দুই কান ভরে ফেললাম ধানে। এতে আমি আনন্দও পাচ্ছিলাম। কারণ বিশ্বাস ছিল যে, আমার কান-বাগানে অনেক ধান হবে। সেই ধান দিয়ে খই ভাজা হবে! কিন্তু বাস্তবে যা হলো, তা ছিল আমার কল্পনার অতীত। কিছুক্ষণের মধ্যেই কানের মধ্যে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হলো।
অবস্থা গুরুতর। আব্বা দুশ্চিন্তায় পড়লেন, কানের ছিদ্র দিয়ে ধান মাথায় ঢুকে পড়ে কি না। ফলে অতিসত্বর মা ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে খুলনার পথে ছুটলেন। আব্বা সারা রাস্তা আমার মাথা সোজা করে ধরে বসে রইলেন, যেন বেশি নড়চড় না হয়। আম্মা আমার চোখের সামনে নতুন আরেকটি বই খুলে পাতা ওলটাতে ওলটাতে চোখ মুছছেন, আর দোয়া পড়ছেন। আব্বা আমার কষ্ট কমাতে বারবার বলছিলেন, ‘মা তোমাকে অনেক অনেক বই কিনে দেব। বই পড়ার সময় তোমাকে যাতে কেউ আর ধানওয়ালা খই না দেয়, তাও বলে দেব।’
হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক মিলে আমার কান ধানমুক্ত করেন এবং আমাকে মুক্তি দেন অসহ্য যন্ত্রণা থেকে। আব্বা আম্মা আমার শরীরে কোনো দিন এতটুকু টোকাও দেননি; কিন্তু শরীর ভালো হতেই সেজ বোন লাভলি আপার কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই চড়-চিমটি খাওয়া শুরু করলাম। অপরাধ, কানের মধ্যে ধান জমানো এবং তাদের ঈদ মাটি করা!
এ ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি কতটা ছিল জানি না। তবে সেই সময়ের যন্ত্রণা ও ভয় এবং পরে সেজ আপার আক্রমণ আমার জীবনটাকে ‘হেল’ করে দিল। সেজ আপা এখনো সুযোগ পেলেই আমার উদ্ভট আচরণের ব্যাখ্যা দিতে এই গল্পটি খুব যত্ন করে মানুষকে শোনায় এবং আগুন দৃষ্টিতে আমাকে ভস্ম করতে চায়। ভাবলে আজও অবাক লাগে আব্বা আম্মা কোনো দিন এ নিয়ে আমাকে এতটুকু বকা দেননি। বরং মা প্রতি মাসেই তাঁর বেতনের টাকার একটা অংশ দিয়ে আমার জন্য বই কিনে আনতেন।
পরের ঘটনাটিও মাই গ্রামেই ঘটেছিল। সেও বর্ষাকাল। আমার দাদাবাড়ির মতো সুন্দর ছিমছাম বাড়ি আমি আর কোথাও দেখিনি। এই বাড়ির শেষাংশে ছিল আদিগন্ত বিস্তৃত নিটোল থইথই পানির বিশাল বিল, যার শুরু আছে শেষ নেই। কী যে চমৎকার, কোনো ভাষাই এর রূপ বর্ণনার ক্ষমতা রাখে না; অন্তত আমি রাখি না। যেন গোবিন্দ চন্দ্র দাশের ‘বর্ষার বিল!’ আমাদের ঘাটে একটা নৌকা, আর একটা ডোঙা (তাল গাছের তৈরি নৌকা) সব সময়ই থাকত। একদিন খুব ভোরে চাচাতো বোন পাপিয়া, সেজ আপা ও আমি চললাম ডোঙায় চড়ে বিলে মাছ ধরতে। বড়শি ও মাছের জন্য ‘আধার’ নিয়ে ডোঙায় বসে আছি। আমাকে দুই বোন মিলে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কী করে তাল গাছের তৈরি গোল তলাবিশিষ্ট ‘ডোঙায়’ ভারসাম্য রাখতে হয়। পানি দেখে ভয়ও পাচ্ছি, আবার উত্তেজনা হচ্ছে। শেষে রওনা হলাম ওদের সঙ্গে। অনেকটা যাওয়ার পরে পাপিয়া আমাকে বড়শি এগিয়ে দিতে বললে বিপত্তি বাধল। উঠে দাঁড়ানোমাত্রই ডিঙির ভারসাম্য নষ্ট হলো। ভয় পেয়ে আমি আরও দাপাদাপি করতে লাগলাম। ডোঙা গেল উল্টে। তিনজন পড়লাম পানিতে। ওরা ভালো সাঁতার জানত। আমি কিছুক্ষণ পরই তলিয়ে গেলাম। তলিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে শুনলাম পাপিয়া চেঁচিয়ে বলছে, ‘কিসি ডুবে না মরলেও সাপের কামড়ে মরে যাবি!’
আমি বেঁচে যাই আমার লম্বা চুলের কারণে। অন্য নৌকার লোকজন ডুব দিয়ে এবং বাঁশ দিয়ে পানির মধ্যে টোকা দিয়ে আমাকে খুঁজছিল। বাঁশের আগায় চুল পেঁচিয়ে যাওয়ায় পানি থেকে উদ্ধার করতে পেরেছিল তারা আমাকে। এরপর আর কোনো দিন আমি ডোঙায় উঠিনি।
আগে পাড়ায় পাড়ায় মেডিকেল টিম যেত। তরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইনজেকশন দিত। আমার তীব্র ভয় ছিল এই সুঁই ফোটানোতে। একবার তাদেরকে বাসার দিকে আসতে দেখেই ছাদে চলে যাই এবং মই বেয়ে পানির ট্যাংকের মধ্যে নেমে যাই। কিছুক্ষণ পর সাপ্লাইয়ের পানি আসতে শুরু করলে আমি বুঝতে পারি যে, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি ডুবে যাব। বুঝতেই ট্যাংকের গায়ে সর্বশক্তি দিয়ে শব্দ করতে শুরু করি। কিন্তু পানির ঝমঝম শব্দে আমার শব্দ ঢাকা পড়ে যায়। কারও কানেই পৌঁছায় না আমার শব্দ। বোনরা খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসে ট্যাংকের গায়ে মই লাগানো দেখে উঁকি দিতেই ডুবন্ত আমাকে দেখতে পায় এবং সে যাত্রায়ও বেঁচে যাই।
এরপরের দুটো ঘটনাই সাইকেল চালাতে গিয়ে ঘটেছে। ঘটেছে বলাটা সঠিক নয়, ঘটতে ঘটতে বেঁচে গিয়েছি। নতুন সাইকেল চালানো শিখেছি। তীব্র গতিতে চালিয়ে আসার সময় সময়মতো ব্রেক ধরতে না পারায় সাইকেলসহ পুকুরে পড়তে পড়তে বেকায়দা টার্ন নিয়ে চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। বেঁচে যাওয়াটা মিরাকল ছিল, শতভাগ!
পরের ঘটনাটি ঘটে আমার স্কুলে, খালিশপুরের রোটারি স্কুল। ছুটির দিন। কিন্তু আমরা অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী স্কুলে গিয়েছি ফুলের টবে রং করে দিতে। সঙ্গে ছিল কবিতা আবৃত্তি ও গানের মহড়াও। পরদিন বার্ষিক অনুষ্ঠান। টবে রং করে সবগুলো একসঙ্গে জড়ো করে রাখা হয়েছে বারান্দায়। আমি কায়দা করে বারান্দায় পিলারের মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে সাইকেল চালাতে গিয়ে একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টবের ওপর গিয়ে পড়লাম। ভেঙে গেল অনেকগুলো টব। আমি তখন সেভেনের, আর সেজ আপা এইটের স্টুডেন্ট। অন্য কাউকে নয়, সেজ আপার ভয়েই আমি সাইকেল ফেলে পাশের মসজিদের স্যাঁতসেঁতে পানির ট্যাংকের নিচে গিয়ে লুকালাম। অনেকক্ষণ পর মাগরিবের আগে আগে সেজ আপাই আমাকে সেখান থেকে খুঁজে পায়; নিচ থেকে টেনে বের করেই ইচ্ছামতো ধোলাই। ভাবছেন এ আর এমনকি? এমন কিছু আছে, যা শুনলে ভয় তো পাবেনই, আমার জোর বরাতেরও প্রশংসা করবেন। সেজ আপা যখন আমাকে ঠাস ঠাস করে মারছে, আর আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদছি, তখনই কালো কুচকুচে নাগরাজ ট্যাংকের নিচ থেকে বেরিয়ে এলেন। আমার সঙ্গে তিনিও ওই একই ট্যাংকের নিচে ছিলেন! মুসল্লিরা সেই বিষধর সাপটিকে পিটিয়ে মারেন। সেজ আপা মার থামিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি নিয়ে আসে।
আমার বাবার বাড়ির চারতলার ছাদ খোলা; কোনো রেলিং নেই। সবাই দেখি ছাদের কার্নিশে বসে বসে গল্প করে, মুড়ি খায়, চা খায়। আমি কখনো কিনারে যেতে পারি না; নিচে তাকালেই বুক ধড়ফড় করে, হাত-পা কাঁপতে শুরু করে, মাথা ঘোরে। সে জন্য আমি আমাদের দোতলার ছাদেই থাকতাম। চারতলার ওপরে খুব কম যেতাম। গেলেও ছাদের মাঝখানে বসতাম; নিচে তাকাতামই না। হঠাৎ একদিন এক ভাড়াটিয়া ভাবি জোর করে ধরে আমাকে ওই ছাদের কিনারায় নিয়ে গেলেন। আমার যে অ্যাক্রোফোবিয়া আছে, জানতাম না। হঠাৎ মনে হলো আমি ওপর থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছি এবং এই ভাবতে ভাবতে আমি ছাদের ভেতরের অংশে না এসে বরং ঝুঁকে যাচ্ছিলাম আরও কিনারের দিকে। এক মুহূর্তের হ্যাঁচকা টানে আমি আমার জীবন ফিরে পেলাম। ভাবি আমার টালমাটাল অবস্থা দেখেই প্রচণ্ড টান মারেন। অদ্ভুত ব্যাপার, আমি আজও হঠাৎ হঠাৎই ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে জেগে উঠি একরাশ আতঙ্ক নিয়ে। দুঃস্বপ্ন দেখি, অনেক অনেক উঁচু থেকে পড়ে যাচ্ছি নিচে; পড়ছি তো পড়ছিই।
এর পরের ঘটনাটি বেশ মজার। আমার হিটলার সেজ আপার বর চাকরি করতেন বন বিভাগে। বদলির চাকরি। সিলেটের বিভিন্ন বনাঞ্চলে তিনি দীর্ঘ দিন কর্মরত ছিলেন। আমি সেজ আপার সঙ্গে প্রথম বনে বেড়াতে গিয়েই দারুণ মুগ্ধ হই। বনজঙ্গলের আলোহীন জীবন, আদিবাসী, হাতি, চা বাগান, রাবার বাগান, সবই আমাকে ভীষণভাবে টানত। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলেই আমি আপার বাসা অর্থাৎ সিলেটের পথে রওনা হতাম। এই সিলেটর বনাঞ্চলই আমার পরবর্তী ঘটনার কেন্দ্র।
প্রথম ঘটনাটি হবিগঞ্জে। আপার বাংলোর পেছনেই ছিল খোয়াই নদী; খুব একটা চওড়া নয়, কিন্তু বেশ খরস্রোতা। আমরা কাজিনরা দল বেঁধে গিয়েছিলাম হবিগঞ্জে। হঠাৎ খালাতো বোন পলি বুদ্ধি করল, আজ বৃষ্টির মধ্যে খোয়াই নদীতে বেহুলা-লখিন্দরের ভেলা ভাসাতে হবে। কেউ বাথরুমে গোসল করবে না, সবাই নদীতে যাবে। যেই কথা, সেই কাজ। বয় ও গার্ডদের ডেকে বলা হলো, ‘কলা গাছ কেটে ভেলা বানিয়ে দাও।’ তাঁরা এহেন অভিনব আদেশ তামিলে একটুও পিছপা হলেন না, বরং ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বড় বড় কলাগাছ দিয়ে বিরাট ভেলা তৈরি হলো। ফাটাফাটি ব্যবস্থা, টান টান উত্তেজনা। পাঁচ পাঁচটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পডুয়া তরুণীর সমন্বয়ে গঠিত বেহুলা-লখিন্দর টিম নেমে গেল পানিতে। শুটিং শুরু হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই ভেলাটি একটু একটু করে এক পাশে কাত হয়ে ভুস করে উল্টে গেল। কারণ, সবাই একপাশে বসেছিল! সবাই সাঁতরে এদিক-ওদিক চলে গেলেও আমি পড়ে গেলাম বিশাল সেই ভেলার নিচে, মাঝখানটিতে। যেদিক দিয়েই বের হতে যাই শুধু ভেলা আর ভেলা। বের হওয়ার মতো ফাঁকা জায়গা কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। নিশ্বাস আটকে মরণ দশা। তবে যেকোনোভাবেই হোক সেবারও মরতে মরতে শেষে বেঁচেই গেলাম। বলাই বাহুল্য সেই বুড়ো বয়সেও সেজ আপার হাতের মার খেতে হয়েছিল; অপরাধ, ‘সবাই ঠিক থাকে, তুই কেন মরতে বসিস!’
শেষ ঘটনাটি লংলা ফরেস্টের। এটা সিলেটের ভীষণ গহিন এক বন। এখানে এদিকে ওদিকে অহরহ সাপের খোলস পড়ে থাকতে দেখা যায়। খাসিয়া সরদারের বাড়ি গিয়ে দেখেছিলাম ওরা পান চাষের সঙ্গে সঙ্গে সাপেরও চাষ করে। বিভিন্ন আকারের বাটি ও হাড়িভর্তি নানা জাতের সাপ, সাপের বাচ্চা! ওরা সাপ খায়ও! এই বনে বলা নেই, কওয়া নেই হাতির পাল নেমে আসে যখন-তখন! সারা বন প্রকম্পিত করে একটু পরপরই হনুমান ডেকে ওঠে। একজন ডাকলে সবারই গলা মেলানো চাই। স্টেশন থেকে নেমে জিপে করে আপার বাংলো পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়ে সারা শরীর ব্যথায় টনটন হয়ে গিয়েছিল। দুলাভাই দল নিয়ে হাতির পিঠে পিঠে ঘোরেন। গাছে গাছে হুতোম প্যাঁচা ও বানর। ভীষণ অন্ধকার এই বনে আলো কম, প্রচুর মশা। আমি মশারি টানিয়ে বই পড়ি ও প্রায় প্রতি দিনই হাতির প্রদর্শনী দেখি; বড়, মাঝারি, ছোট ও বাচ্চা হাতি।
আপার বাংলো ছিল পাহাড়ের বেশ ওপরে। বয়েরা বালতি ভরে ভরে সারা দিন ধরে নিচ থেকে পানি বয়ে আনত; খাবার, রান্না, গোসল সবকিছুর জন্য। একদিন আমরা পরিকল্পনা করলাম, আর তোলা পানি দিয়ে গোসল করব না। নিচে গিয়ে ছড়ার পানিতে গোসল করে পাহাড় বেয়ে বাড়ি চলে আসব। আপা বলল, ‘এই বনে বাঘও আছে অনেক।’ আমরা আমতা-আমতা করতে করতে তোয়ালে নিয়ে নেমে গেলাম নিচে।
ছড়ার পানি অতি স্বচ্ছ। অনেক দিন পর খোলা জায়গায় এসে খুব ভালো লাগছিল। আমরা পানির মধ্যে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ ছোট ভাই রুবেল চিৎকার করে বলল, ‘ছোট আপা সরে যা, কী যেন ফণা তুলে আসছে!’ বলেই ও ছড়া থেকে উঠে গেল এবং আমি এক ইঞ্চির জন্য ফণার ছোবল থেকে বেঁচে গেলাম। ওটা ছিল একটা সাপ এবং সাপটা পরে আমার পাশের ভেসে থাকা কাঠের টুকরোর ওপর দিয়েই বনে ঢুকে গিয়েছিল। সেটাই ছিল আমার প্রথম ও শেষ ছড়া-স্নান!
আল্লাহর এই দুনিয়ায় যার যতটুকু পাওয়ার, সে ততটুকুই পায়; যার যত দিন বাঁচার, সে তত দিনই বাঁচে, এক মুহূর্ত বেশিও না, কমও না! নিজের জীবন দিয়েই আমি তা বুঝেছি।