একটা সংসার হচ্ছে মানুষ তৈরির কারখানা। শুধু জন্ম নিয়েই যেকোনো প্রাণীর বাচ্চা সে প্রাণীর বাচ্চা হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু মানুষের বাচ্চা জন্ম নিলেই মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। তাঁকে পরিপূর্ণ মানুষ করার জন্য মাতা-পিতাকে কমপক্ষে ২০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। এমন প্রকল্পের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে যে মা থাকেন, তাকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেধা তালিকায় রাখা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন পত্নীকে প্রায়শই চেহারা, রং, সুন্দর এবং বাবার বাড়ির আভিজাত্যের বিচারে গ্রহণ করা হয়। অনভিজ্ঞ কচি বালিকাদের বিয়ের বাজারে মূল্য এখনো অনেক বেশি। আমি কী ভুল বলছি? বয়স বেশি বা সৌন্দর্যের তারতম্যে অতি যোগ্যতাই অযোগ্যতা হয়ে পড়ে। অথচ কী সুন্দর করে আলেক্সান্ডার বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি দেব’।
আবার অনেক মেয়েরাও উচ্চশিক্ষিত হয়ে শুধু স্বামী সংসারের দেখাশোনা করে জীবন কাটাতে চান না। আর্থিক সংগতি থাকার পরও দাম্পত্য জীবনে অশান্তি করে হলেও বাইরের জগতে নিজেকে দেখতে চান। বাইরের পদ-পজিশন ছাড়া যেন নিজের শিক্ষার বিস্তার ঘটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কেন এমন মনে হয়? তবে কী সংসার খুব তুচ্ছ কোনো বিষয়? জ্ঞানের বিস্তার কি গৃহিণীদের কাজ নয়? নিজেকে পরিপূর্ণ সুন্দর করে তোলার জন্য কি বাইরের পৃথিবীর সবকিছুই শুধু মানানসই? আমার তো মনে হয়, প্রতিটি মুহূর্ত একটা বাচ্চাকে বাড়তে দেখার মধ্যেও করার আছে অনেক কিছু। আমি একবার পাওয়ার পয়েন্টে আমার মেয়ের জন্ম থেকে বড় হওয়া প্রতিটি মুহূর্ত নোট করে করে রাখলাম। মনে হয় অনেক কাজ। এখনো ইচ্ছে করে। মেয়ে কখন কোন ছয়ফুল কথা বলে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে। একজন মা ঠিক একজন মালির মতো, যাকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হয় সন্তানের গায়ে সূর্যের আলো ঠিকমতো লাগছে তো?
অনেকে হয়তো সংসারের কথা ভেবে, চাকরি পড়াশোনা সব ছেড়ে দেন। কিন্তু জীবনের শেষ বয়সে এসে দেখেন, কাউকে তো খুশি করতে পারলেন না। তার কারণ কি? তার কারণ, ভেতরে-ভেতরে তিনি নিজে কখনো খুশি ছিলেন না। উঠতে-বসতে মনে রেখেছেন এই সংসারের জন্য আমার কিছু হলো না। তার প্রতিটি কাজে দীর্ঘশ্বাস, ব্যথা মেশানো ছিল। তেমনি শারীরিক অবস্থায়ও প্রভাব ফেলে। এ জন্য অনেক ভালো খাবার রান্নার পরও অনেক স্বামী-সন্তান খেয়ে বলে না যে, তারা খুশি। বলে, এটা কী রান্না করেছ! আমি খাব না। দিন শেষে একজন গৃহিণী সারমর্ম হল, কাউকে তো খুশি করতে পারলাম না! হায়! সুতরাং সবার আগে উচিত নিজের খুশি দেখা। অন্যের খুশির জন্য নয়, নিজের খুশির জন্য করুন। নিজের খুশি ঠিক রেখে যদি অন্যকে কিছু দেওয়া যায় বা করা যায়, তখন তার গুণগত মান খারাপ হলেও আনন্দ দেবে। এ জন্য একজন মায়ের মানসিক স্থিতিশীলতা খুব প্রয়োজন। কিন্তু সংসারে একজন মা কতখানি আনন্দে আছেন?
একটা সংসারে যে বাচ্চা আসে, সে হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ নেতা, ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী বা জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এদের যথাযথ ম্যানুফ্যাকচারিং, প্যাকিং, শিপিং করার জন্য তো সবচেয়ে শক্তিশালী মেশিন দরকার। যে মেশিন হয়ে উঠতে পারেন কেবল একজন মা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন সব হিরার টুকরো সন্তানরা বড় হয়ে ওঠে গৃহপরিচারিকা, ড্রাইভার এদের ছত্রচ্ছায়ায়। জীবনের চাহিদা। সমাজের অবস্থান। এসব গড়তে গড়তে আমাদের নিজেদের এনার্জি যখন সবচেয়ে বেশি ক্ষয় হয়, তখন আমরা আর সন্তানকে কী হাই এনার্জি দেব। তারপরও যে আমরা দিচ্ছি না, তা নয়। কিন্তু আমাদের সে দেওয়ার মাঝে থাকে ক্লান্তি। তবে ব্যক্তিভেদে ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। একজন মায়ের হাসিখুশির ওপর সন্তানের জীবনে আনন্দবেদনা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে। মা যখন ক্লান্তি নিয়ে খাবার দেন, সে খাবার কখনো হাই এনার্জি ফুড হতে পারে না।
আধুনিক দুনিয়ায় দাদা-দাদি, নানা-নানির যে গুরুত্ব তাও কেড়ে নিয়েছে। সামাজিক অবস্থা দৃষ্টিভঙ্গি বিচারে তাঁরা হয়ে পড়েছেন খুব বেশি সেকেলে। গবেষণা বলছে, পরিচারিকারা বাচ্চাদের সময় মতো বেশি খাইয়ে ফেলে সত্য। খুব গুছিয়ে খাওয়ায়। টিভি বা ভিডিও গেমে বাচ্চা ব্যস্ত, সে কী খাচ্ছে তা জানেও না। এ জন্য তাঁর চেয়েও বেশি স্বাস্থ্যসম্মত গ্র্যান্ড প্যারেন্টসের হাতের অল্প খাবার। কারণ, তাঁদের পরিবেশনায় থাকে দোয়া, সেই সঙ্গে পজিটিভ কোন থট, গল্প। টিভি-ভিডিও গেমের অনেক বিষাক্ত পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে যে খাবার যায়, তা কেবল শরীর গঠন করে না, মানসিক বিকাশে স্বাস্থ্যকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন এলান করছে, খাবারের সময় টিভি, কম্পিউটার, ডিভাইস ব্যবহার না করতে। ভয়ের দৃশ্য মনকে ভীত করছে। খাবার-দাবার, পানি বাইরের সব আসপেক্ট থেকে ভাইব্রেশন গ্রহণ করে। যা মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। এসব কিছু লক্ষ্য রাখার জন্য একজন মায়ের ভূমিকা অনেক।
প্রায় চার মাস হতে চলল, বলা যায় আমি ফুলটাইম মায়ের জব করছি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা যাই থাকুক না কেন, একটু স্বার্থপরের মতো বলতে হয়, আমি খুব উপভোগ করছি এই ফুলটাইম মাতৃত্ব। জীবনে আমি এটা মিস করেছি বেশি। মেয়ে ছোট ছিল। বুকের দুধ পান করতে পারিনি। সে চার মাস বয়স থেকে রেখে কাজ করতাম। বাড়তি কিছু উদ্বেগ্ন ছিল, কাজের লোকের কাছে রেখে যেতাম ঘরে। যদিও তাঁরা অনেক নির্ভরযোগ্য ছিলেন। এখানে তো তাও কেউ ছিল না। ১০ বছর বয়সের মেয়েকে ঘুমে রেখে শেষ রাতে বের হতাম। বর্তমান এই পরিস্থিতিতে বাইরে থাকলে হয়তো অন্য রকম চিন্তা করতাম। যদিও এটা কাটিয়ে উঠতে হয় কীভাবে আমি শিখেছি। স্পিরিচুয়ালিটি আমাদের এ শিখায়, উদ্বেগ অনেকটা বদদোয়ার মতো কাজ করে, যা বাচ্চাদের ভালো থাকার অন্তরায়। অথচ কত ভুল সমীকরণে আমরা চলি। চিন্তা না করে তার চেয়ে দূরে থেকেও বলো, ‘আমার বাচ্চা ভালো আছে’। একজন মায়ের কত কী শিখতে হয়? মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। পনেরো বছরের বুড়ো মেয়ের জন্য পাখি মায়ের মতো খাবার তৈরি করা বা জোগাড় করা—এটাই আমার প্রধান দায়িত্ব এখন।
লক্ষ্য করলাম ঘরের কোন একটা কাজ যেমন ঝাড়ামোছা হোক বা অন্য কিছু। শুরু করলে একটার পর একটা সামনে আসতে থাকে। কর্মজীবী মা হিসেবে আমার মতো যাঁদের ঘরে–বাইরে দায়িত্ব থাকে, তাঁদের হয়তো অনেক কিছু তলিয়ে দেখার, বিশ্লষণ করার সময় থাকে না।
আমিও এটাকে অপশনাল হিসেবে করে গেছি। যতটা সম্ভব যত্ন, মায়ামমতা, ভালোবাসা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু এখন অনেক কিছু লক্ষ্য করি। একটা সংসারের কাজ, সেটা কতটা দক্ষতা নিয়ে করতে হয় বা করা উচিত, তা হয়তো ব্যস্ত জীবনে আমরা ভাবারও সময় পাই না। সংসারে একজন নারী শুধু মা বা স্ত্রী নয়, একটা সংসারের মহাব্যবস্থাপক বা সংসার ম্যানেজার। সে মাকে, নারীকে সংসারে প্রতি মুহূর্ত খুশি থাকা জরুরী। একজন রমণীর ইমোশনাল স্বাস্থ্য ঠিক রাখা মানে নিজেকে হাই এনার্জি দেওয়া। হাই এনার্জি যা আপনার সম্পর্ককে হাই এনার্জি দেয় এবং সম্পর্ক ঠিক রাখে। আমাদের সে ব্যপারে সচেতন হওয়া খুব প্রয়োজন।