
হৃদয়ের গহিনে কীর্তন গর্জে প্রতিনিয়ত, জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে কিছুটা সময় একান্ত নিজের করে পেতে চায় মন। শৈশবে হারিয়েছি বাবাকে। আর যৌবনে যখন মাকে চেয়েছি নিজের প্রয়োজনে, তখন মাও যে ফাঁকি দিয়েছেন চলে গেছেন। তবুও মাঝে মাঝে স্মৃতির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে হাতরে বেড়াই সেই নিরলস দিনগুলো। এখন বোনরা ছাড়া আর কাউকেই রক্তের বন্ধনে আবৃত করতে পারি না। তাদের ছায়ার মাঝেই যেন আমাকে কখন ছোট বোন কিংবা কিছুটা বড় বোনের জায়গায় দেখি। সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। এখানকার যান্ত্রিক জীবনের কিছুটা অবসাদ মেলে ছুটির দিনগুলোতে। বন্ধুরা মিলে কোন পার্কে চলে যাই, সিনেমায় অথবা কারও বাসায় ওয়ান ডিশ পার্টির ভোজন আর আনন্দ আড্ডা। রঙিন ঘুড়ির মতো মন ছুটে চলতো আকাশের সীমানায়।
এখানে স্কুলে কাজ করি, অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। বিশেষ করে কাজের সময় ফোন বন্ধ রাখার নিয়ম। তবুও আমরা মোবাইলের সাইলেন্ট রেখে কাজ করি। আমি তখন কিছুটা ব্যস্ত ছিলাম ক্লাসে একটা বাচ্চাকে নিয়ে, আমার নিস্তব্ধ ফোনটা হঠাৎ করে ভাইব্রেট শুরু করল, কিছুক্ষণ পর পর। আমি বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে ফোনটা দেখতেই দেখি, সব ফোনকলই বাংলাদেশ থেকে এসেছে। আমি কলব্যাক করতেই আকাশটা যেন হঠাৎ করে শূন্য হয়ে গেল। আমার বুবুর স্বামী হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। সেদিন দেখেছি এই ভিন দেশিদের মাঝেও মানবিকতার কত যে মূল্য। ওরা আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য এবং যেভাবে সমবেদনা জানিয়ে ছিল, তা আজীবন মনে থাকবে। আমি ফিরেই দেশে কল দিতেই সবার কান্না, আমি আর বুবুর সঙ্গে ঠিক করে কথা বলতে পারিনি। আমার বাচ্চারা দেখেছে, আমি যেন সদ্য বাবাকে হারানোর ব্যথায় কাতর। দুলাভাই বাবার মতোই ছিলেন।
আমার বড় মেয়ে এনওআইইউতে চাকরি করে। জুন মাসের শেষের দিকে মেয়ে হঠাৎ বলল, মা তোমার ইমেইল দেখো। আমি তো হতবাক, সে আমার আর ওর জন্য দেশে যাওয়ার টিকিট কেটেছে। আমিও আর লোভ সামলাতে না পেরে বোনদের টানে দেশে গেলাম। বুবু আর আমি নদী ভাঙনের মতো কেঁদেই চললাম। দেশে তখন ডেঙ্গুর খুব প্রকট অবস্থা। বাইরে প্রয়োজনে বের হওয়াটাই যেন হুমকির অবস্থা। তবুও জীবন থেমে নেই, বয়সের ভারে নতজানু হয়ে বেঁচে আছেন একমাত্র মেজ চাচা, তাঁকে দেখে এলাম। আবার কবে আসব, কাকে দেখব বা দেখা হবে না, এই ভেবেই ছুটে চলেছি কিছু আপনজনের কাছে। আহা সে কি আনন্দ হৃদয়ের দোলনায়। ডেঙ্গুর কারণে মেয়ের আর যাওয়া হলো না। তাই ওরা ছিল ঘর পরিষ্কার, আবর্জনা ফেলা, রান্না করা, লন্ড্রি করা এবং বাবার খেয়াল রাখাতে। আমার সব কাজ যেন দুই মেয়েই ভাগ করে নিয়েছিল।
কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পেরেছিলাম বাচ্চাগুলোর জন্য। বাচ্চাদের জন্য কিছু শপিং করেছি, কিছুটা নিজের জন্যও। দেখতে দেখতে ফিরে আসার দিন এসে গেল। আকাশে হাতটি উঠিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বিদায় জানালাম। বাচ্চাদের ফিরে পাওয়ার চেয়ে ওদের ছেড়ে যাওয়ার ক্ষতটা অনেক গহিন ছিল। লম্বা পথ অতিক্রম করে ধরনীর বিস্তৃত খোলা মাঠ আমন্ত্রণ জানাল। কত তাড়াতাড়ি শেষ হলো জীবনের দেখা মিলতে, যেন গোলকধাঁধার মতো মনে হল। দৌড়ে আমাকে ঝাপটে ধরে বাচ্চারা বোঝাল, এই আমার বর্তমান। নিজের ঘরে অতিথির মতোই অনুপ্রবেশ হলো আমার। ওদের জন্য কী এনেছি, তা দেখাতে তৎক্ষণাৎ বিরক্ত করেনি। ওদের খুশির আনন্দের মাঝেই তো আমার আমিকে পাই। মাঝরাতে আর ঘুম এল না, কী করব ঘরের কোন কাজ করার আগেই ঠিক করলাম সকালে ওদের কী নাশতা দেব। দুপুরে কী রান্না করব। বাজার আছে তো? সকালে চুপচাপ কাজ শুরু করে দিলাম, একের পর এক।
সকাল ১০টার মধ্যে কিছু গ্রোসারি করে আসলাম। শুরু হয়ে গেল আবার নিত্য জীবনের সূচনা। দুই দেশের যাপিত জীবনের মাঝখানে ঘুমের যে সমস্যা, তা প্রথমেই ঠিক করে নিতে চেষ্টা করি, এর পরপরই স্কুল শুরু হয়ে গেল, রুটিনের মতো চলতে শুরু করল জীবন। এরই ফাঁকে আত্মীয়–পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ, কিংবা দেখা করতে আসা অথবা বন্ধুদের সঙ্গে কুশল বিনিময় চলছে এভাবেই। কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও কারও কোন খারাপ কিছু শুনলে মন যেমন ভীষণ খারাপ লাগে, তেমনি কারও একটু ভালো খবর ও আনন্দে ভরিয়ে দেয়। সামাজিক বন্ধনে আমরা বন্ধু প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়–অনাত্মীয় সবাইকে নিয়ে চলছি এবং চলব সুন্দর একটা পরিবেশ নিয়ে। সমাজের সব ধরনের মানুষকে নিয়েই আমার ক্ষণিকের জীবন। সেখানে থাকবে সুখ বিষাদ আনন্দ অথবা জম্পেশ আড্ডা। আর থাকবে প্রতিদিনই নতুন করে কিছু শেখা, নতুন পরিচয়, নতুনের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। প্রবাস জীবনে ক্ষুদ্র চাওয়ার মাঝে কিছুটা পাওয়ার মাঝে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া।