Thank you for trying Sticky AMP!!

সিলেটী বিয়ের গান ও ধামাইল নাচগান

শহরের মঞ্চেও এখন ধামাইল নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই বিয়ের প্রচলন হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন আমল থেকে দেশ ও জাতি ভেদে চলে আসছে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। বিয়ে মানেই দুটি হৃদয়ের সেতু বন্ধন। এখন কথা হচ্ছে, বিয়েটা কী এবং কেন! বিয়ে হচ্ছে একটা সুন্দর ও নিখাঁদ পার্টনারশিপ। এক জোড়া নারী-পুরুষের বৈধ উপায়ে বসবাসের উদ্যোগ নেওয়ার নামই হচ্ছে বিয়ে। ঘর বাঁধার স্বপ্ন পূরণ, নতুন সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে নতুন উল্লাসের সূচনা বিয়ে।
এই বিয়েকে কেন্দ্র করে একেক সমাজে রয়েছে একেক ধরনের আয়োজনের। প্রাচীনকাল থেকে বিয়ে সংঘটিত হচ্ছে তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে। এখনো অবশ্য গ্রামে গঞ্জে পুরোনো প্রথাটিই বিদ্যমান। তবে সময়ের সঙ্গে বিয়ের আয়োজনেও এসেছে পরিবর্তন। আগে বিয়ের অনুষ্ঠানকে উদ্‌যাপন করা হতো খুবই আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে। গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানকে উপভোগ করা হতো মাইকে উত্তেজক হিন্দি গানের মাধ্যমে। কিন্তু এই পদ্ধতিটা চালু ছিল নিম্নবিত্ত সমাজে।
শহরের মধ্যবিত্ত সমাজে বিয়ে হতো সানাই বাজিয়ে। কিছু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের বিয়ের অনুষ্ঠানে শুধু সানাইয়ের করুণ সুর বাজত। এই প্রথাগুলো চালু ছিল বাহ্যিক পরিমণ্ডলে, যার কেন্দ্রে থাকত পুরুষেরা।
বিয়ের গান সিলেটবাসীর ঐতিহ্যের একটি অংশ। তবে এটি যে একক কোনো পথে এসেছে, তা নয়। মানুষ থেকে মানুষে, আদি থেকে বর্তমানে এসেছে চর্চার পথ ধরে। এই গান রচনা বা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তেমন কোনো বিশেষ উদ্যোগ বা পদ্ধতি নেই। শুধু মনের মাধুরী ও অভিব্যক্তিতে গানগুলো প্রবাহিত হয়ে বিয়ের গানের ধারাকে করেছে সমৃদ্ধ।
অন্দরমহলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হতো নারীদের পরিচালনায়। বঙ্গজ, ঢোল ও মন্দিরা ব্যবহার হতো প্রধান বাদ্যযন্ত্র হিসেবে। শীতলপাটি কিংবা মাদুর বিছিয়ে চার-পাঁচ জনের একদল নারী বিয়ের গান পরিবেশন করত।
একসময় বিয়ের গান শুধু কনেপক্ষেই গীত হতো। পরে এটি আর কনেপক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়ে। প্রকারভেদে বর ও কনের বাড়িতে বিয়ের গানের আসর বসত। এখানে কনেপক্ষের কিছু গানের শুরু ছিল এ রকম—
‘বিয়ের দিনে রঙে ঢঙে নাচইন কি সুন্দর
কইন্যা যাইতা স্বামীর ঘর
দাদি নানি চাচা চাচি, কান্দি জারেজার
আমরার ঘরখান আন্দাইর অইয়াজার
কইন্যা যাইতা স্বামীর ঘর।।’
কনের ছোট বোন তার বান্ধবিকে গানের সুরে দাওয়াত করছে এভাবে—
‘আমার বাড়ি যাইও তুমি
আমার বুয়াইর বিয়া গো বইনারি
কাইল বিয়ানে আইবা দুলাভাই’
কনের মেহেদি অনুষ্ঠানেও গীত হয় এক ধরনের গান, যার শুরুটা এমন—
‘মেন্দি পিন্দইন ছাবাল কইন্যায়
বিয়ার খাটে বইয়া
মেন্দি হাতে দিয়া কান্দইন
আনাইয়া বিনাইয়া।’
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানে মিষ্টির সঙ্গে পানসুপারির বিশেষ প্রচলন আছে। শ্রুতি আছে যে, পান-সুপারি নিয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে ঝগড়া শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে ভেঙে যাওয়ারও উপক্রম হয়। পান নিয়ে একটি গানের কলি এমন—
‘পান পান করিয়া ডাকি দেওনা খেনে পান
একটা নিল বরণের পান
আধা পয়সার পানর লাগি
এত অপমান
একটা নিল বরণের পান’
সুনামগঞ্জের আরপিননগর ও তেঘরিয়া অঞ্চলে বরপক্ষের বাড়িতে বরকে উপলক্ষ করে কিছু গান গীত হয় যেমন—
১। ‘মাথা ভালা দামান্দের ডাব নাইরকল জোরারে
কমর ভালা দামান্দের হুন্দি বেতের মুড়ারে।
দামান্দেরো সাত ভাই সাত ঘোড়ার সুয়ারি
একেলা দামানরাজা যাইতা শ্বশুরবাড়ি’
২। ‘যাইন দামান বন্দর বাজারে
কত রঙ্গে বিরঙ্গে।’
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বহুজাতিক নৃগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের বিয়ে কিংবা বিভিন্ন আচারানুষ্ঠানে নৃত্য-গীতের প্রচলন লক্ষণীয়। বিশেষ করে সিলেটের মণিপুরী সম্প্রদায়ের কথাই ধরা যাক। মোঙ্গলীয় তিব্বতিধর্মী ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনো এক সময় চীন থেকে পৈরতন নামে এক দম্পতির নেতৃত্বে তারা মণিপুর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসতি শুরু করে। তাদের বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে কৃষ্ণলীলাকেন্দ্রিক নাচ-গানের প্রচলন রয়েছে।
আদিকাল থেকে সিলেটের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ধামাইল গানের প্রচলন রয়েছে। তৎকালীন বৃহত্তর আসাম ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ধামাইল গানের প্রচলন শুরু হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানকে আনন্দমুখর করতে এ ধামাইল নৃত্যগীতি খুবই জনপ্রিয় ছিল। সাত-আটজন নারী গোল হয়ে প্রথম একজন গান ধরে বাকিরা তাকে অনুসরণ করে। গানের তালে তালে চলতে থাকে নাচ। নৃত্যরতরা দু হাতে তালি বাজাতে বাজাতে নাচতে থাকে। এতে সাধারণত কৃষ্ণলীলাই প্রাধান্য পায়। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহের কিছু অংশে ধামাইল গান এখনো জনপ্রিয়।
সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুরের কেশবপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া বাউলসাধক রাধারমণ দত্তকে সিলেটের ধামাইল গানের জনক বলা হয়। সুনামগঞ্জের আরেক বাউল কবি শাহ আব্দুল করিমও কয়েকটি ধামাইল গান রচনা করেছেন। তাঁর রচিত একটি ধামাইল এমন—
১। ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছইওনা গো সজনি।’
বাউল রাধারমণের অনেক বিখ্যাত ধামাইল গানের মধ্যে কয়েকটি গান এমন—
১। সই গো তুরা কুঞ্জ সাজাও গিয়া
আসবে শ্যাম কালিয়া
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
এ গো আসবে আমার প্রাণবন্ধু
বাঁশিটি বাজাইয়া, কুঞ্জ সাজাও গিয়া।
২। জলে গিয়াছিলাম সই
কালার কাজলের বাটি রাইখা আইলাম কই
জলে গিয়াছিলাম সই।
৩। জলের ঘাটে দেইখ্যা আইলাম
কী সুন্দর শ্যামরায়
ভাইবে রাধারমণ বলে পাইতাম যদি হায়রে হায়
শ্যামরায় কমলায় ঘুইরা ঘুইরা মধু খায়।
৪। তোরা কুঞ্জ সাজও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে।
৫। আমি রাধা ছাড়া কেমনে বাঁচি একা
আমায় বল না সুবল সখা।।
রাধার কথা মনে হলে
বুধ ভেসে যায় নয়ন জলে গো।
বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে ধামাইল গানের প্রচলন আজও হারিয়ে যায়নি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ধামাইল নাচগানকে জিইয়ে রাখছেন। কোনো কোনো সংগঠন ধামাইল গানকে আধুনিকায়ন করে ব্যান্ডের মাধ্যমে উপস্থাপনার চেষ্টা করছেন। এতে অবশ্য অনেকে পুরোনো এ সংস্কৃতির আদি রস হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।