
বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা চলেছে একটা রিইউনিয়ন হবে। হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ মেসেজ থেকেই পরিকল্পনার শুরু। কথা ছিল সবাই সপরিবারে যোগ দেবে। থ্যাংকসগিভিংয়ে ছুটির সঙ্গে শনি-রবি মিলিয়ে টানা চার দিনের ছুটি। আমার বরের চেহারায় টান টান উত্তেজনা। অনেক দিন পর পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। গ্রুপে একেকবার একেকজনের সঙ্গে কথা বলছে। আমি এ পাশ থেকে টের পাই তাদের উত্তেজনা। ফোনে কথা বলার সময় কেমন হাত-পা ছুড়ছে। চোখে মুখে হাসি লেগেই আছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে হাসার সময়ে বিশাল ভুঁড়িটা নেচে উঠছে। সে নির্বিকার; আমরা সব টের পাচ্ছি।
শুরুতে আমি কিছুটা সংশয়ে ছিলাম। হচ্ছেটা কী? অন্যসময় আমি হাজারটা কথা বললেও তার মুখ থেকে কথা বের হয় না। আর এখন কথার খই। সে একা নয়। ফোনে একদল বুড়ো খোকার কথার জ্বালায় ঘুমাতে পারছিলাম না। তারা দুই দেশ, রাত-দিন এক করে ফেলছিল। এর মধ্যে অধিকাংশ কথাই চাটগাঁর গালি। কে যে কাকে গালি দিচ্ছে, বোঝার উপায় নেই।
এক মাস আগে থেকেই তাদের মিলনমেলায় যোগ দিতে আমি ছুটি নিয়ে রেখেছিলাম। মোটামুটি শীত শুরু হয়ে গেছে নিউইয়র্কে। টার্কি খাওয়ার পরদিন আমরা রওনা দিলাম নর্থ পোটোমেক, মেরিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য জুয়েল ভাইয়ের বাসা। সারা দিন আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা। রানা, আমার স্বামী গাড়ি চালায়, আর তার মেয়েদের বলতে থাকে কারা এই মিলনমেলায় আসবে। তাদের কার কার সঙ্গে কত দিন পর দেখা হবে, এসব গল্প চলতে থাকে। এরই মধ্যে বড় মেয়ে আমাকে বলল, ‘এই চার দিন বাবা যেমন চায়, তেমন করে সবাইকে চলতে হবে।’ মনে মনে ভাবছিলাম, আমিই তাদের দুজনকে এমনটা বলব। এর মধ্যে ছোটটাও বলল, ‘বুঝছ মা?’ তার মানে তারা আমাকে নিয়েই চিন্তিত।
পৌঁছে গেলাম সময়মতোই। বরের উত্তেজনায় আমি শীত তেমন একটা টের পেলাম না। বাড়ির পেছন দিকটায় পাইন গাছ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। ছিমছাম শান্ত পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর মধ্যেই বেরিয়ে আসেন সাইফুল ভাই। আগেই পৌঁছে গেছেন মতি ভাই ও চপল ভাই। চার বন্ধুতে প্রচণ্ড জড়াজড়ি চলল। আমার বরের চেহারা দেখার মতো হয়েছে। মনে হলো, বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। একটা বন্দী হরিণ যেন ছাড়া পেয়েছে। মনে হলো, অতিরিক্ত খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে মাঝে মাঝে।
আজকাল এতটা ধবধবে সাদা বাসা চোখে পড়ে না। ফ্লোর থেকে দেয়াল সব ক্রিম সাদা। চোখে পড়ার মতো সাজানো গোছানো পরিপাটি বাড়ি। ঘরের প্রতিটি কোনায় আধুনিকতা ও আভিজাত্যের ছাপ। বাসার ভেতর আরও অবাক করা ব্যাপার ছিল অপেক্ষায়। সাইফুল ভাইয়ের ছেলে পায়জামা-পাঞ্জাবি ও বিয়ের পাগড়ি পরে বর সেজে বসে আছে। সাইফুল ভাইয়ের স্ত্রী শামা ভাবি বললেন, আমাদের জন্য তাঁর সাত বছরের ছেলে সকাল থেকেই বর সেজে আছে। নানা রকম চরিত্রে সাজা তার পছন্দ। খুব অবাক হলাম ওদের হাতে কোনো ট্যাব না দেখে। এই সময়ে দুধের বাচ্চাও দুধের জন্য কাঁদলে মা তাকে ট্যাব ধরিয়ে দেয়। সেখানে আমি এ কি দেখালাম! তাঁদের চার বছরের মেয়ে আমার মেয়েদের পেয়ে খুশিতে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সাইফুল ভাইয়ের সুন্দর সুখী পরিবার।
নিউইয়র্কে আসার পর পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের বাসিন্দা মতি ভাইয়ের সঙ্গেই রানার যোগাযোগটা বেশি। মতি ভাই আবার আমার পাড়াতো বড় ভাই। আমিরাবাগ আবাসিক এলাকা থেকে আমি স্কুল ও কলেজ শেষ করেছি। চপল ভাইও রানার বাল্যবন্ধু; থাকতেন সারসন রোডে। দুজনকেই আমি বিয়ের আগ থেকে চিনি। তাহলে কোন শর্তে আমি তাঁদের বন্ধু নই? মেয়েদের বলেছি, ‘তোরা খেয়েদেয়ে ওপরে গিয়ে বাবুদের নিয়ে মজা কর। আমি এদের সঙ্গে আড্ডা দেব।’
দেশ থেকে আসছেন সুপার হিরো জসিম ভাই। শুরু হয়ে গেল চট্টগ্রামের ভাষায় যত অপ্রচলিত বাক্যবাণ। এ যেন আরেক শিশু। সাইফুল, রানা, মতি, চপল, জসিম ভাই আছেন ভিডিও কলে। বাংলাদেশ থেকে যুক্ত হয়েছেন সাদিক ভাই, রাব্বি ভাই, বিশ্বজিৎ দা, রাজিব দা, কৌশিক দা, শাহীন ভাই, রাশেদ ভাই, অপু ভাই, মাহতাব ভাইসহ সেন্ট প্ল্যাসিডস হাইস্কুলের ৮৪ ব্যাচের অনেকেই। সারা রাত চলে আড্ডা।
জীবনের দীর্ঘ সময় পার করেও কমেনি তাদের বন্ধুত্ব। অটুট রয়েছে ঠিক স্কুলজীবনের মতোই। বাহ্যিকভাবে বয়স বাড়লেও ছোটবেলার বন্ধুত্বের সেই খুনসুটি, মাতামাতি কমেনি এতটুকুও। কেউ কেউ ভিডিও কলে ক্লান্ত হলেও শাকিল ভাই ক্লান্তহীন। তারপরও নির্ঘুম রাত আড্ডাতেও শেষ হয় না। ভোর রাতে সবাই ঘুমের কাছে হার মানে।
পরদিন সকালে দল বেঁধে হাঁটতে বের হই। পাইন গাছের ফাঁকে হালকা রোদের দেখা নেই। রোদ উঠলেও বাতাসে উত্তাপ পাওয়া যায় না। এর মধ্যেই চলছে স্মৃতি রোমন্থন। তাঁদের সবার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও চোখে-মুখে তারুণ্যের প্রকাশ। কেউ বন্ধুর গলা জড়িয়ে হাঁটছেন, কেউবা চিরচেনা গান গেয়ে আনন্দে আত্মহারা। পাইনসকালে বেশি সময় বাইরে থাকা গেল না। আবারও বাসার ভেতরে শুরু হয় আড্ডা, গল্প ও গান। ফাঁকে ফাঁকে চলে ঝগড়া; যেন একদল ক্লাস টেনের ছাত্র।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই একে একে জড়ো হতে থাকেন বন্ধুরা। দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের পেয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আবেগী হয়ে ওঠেন। দুষ্টুমি আর কথার জালে অল্প সময়েই হাসি, আনন্দ, আর গল্পে মুখরিত হতে থাকে ঘর। সন্ধ্যার আগেই যোগ দেন বাবলা ভাই ও তাঁর ছোট ভাই পলাশ। তিনিও সেন্ট প্ল্যাসিডস থেকে পাস করেছেন। আসেন সালমান ভাই। রানা আমাদের আগেই বলেছে, সালমান ভাই তাদের ক্লাসের সব সময়ের ফার্স্ট বয়; জীবনে কোনো কিছুতে সেকেন্ড হননি। একে একে সবাই সালমান ভাইকে বুকে টেনে নিচ্ছে। রানাকে মনে হলো আবেগাপ্লুত। আমার কাছে দুবার এসে বলে গেছে, ‘এই হলো সালমান। ওর সঙ্গে ৩৫ বছর পর দেখা।’ আতিক ভাই এলেন তাঁর ডাক্তার বউকে নিয়ে। কুশল বিনিময় ও হৃদয়ের উষ্ণতায় সবাই যেন পুরোনো সে স্কুল ক্যাম্পাসের দিনগুলোয় ফিরে গেছে।
বন্ধুদের এ আলাপ ও হইচই চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রাণচঞ্চল এক দল টিনএজারকে যেন দেখছি আমি। কৈশোরের নিয়ম ও নিয়ম ভাঙার এসব মত্ততার গল্প আমাকে আবিষ্ট করে রাখে। আড্ডার উত্তাপ আসে সাইফুল ভাইয়ের ছেলের বাউল গানের আসর দিয়ে। বাচ্চাকে গান গাইতে দিয়ে বুড়ো খোকারা গাইতে শুরু করেন—
‘ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান
দইজজার কূলত বসত গরি শিনাদি ঠেগাই ঝড় তুয়ান
ও ভাই আরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান।’
গান, আড্ডা, আর ভোজনে শেষ হয় কিছু অংশ। যারা কাছে থাকেন, তাদের বিদায় জানাতে হয়। তারপর আবার শুরু হয় রাতের পর্ব। এ যেন শেষ হওয়ার নয়। বন্ধুত্বের বয়স কখনো বাড়ে না। বন্ধুত্ব চিরনবীন।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র ক্যাথলিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল সেন্ট প্ল্যাসিডস। বর্তমানে এই স্কুলটির পরিসর বেড়েছে। রূপান্তরিত হয়েছে কলেজে। একাডেমিক শিক্ষার বাইরে খেলাধুলা ও অন্যান্য সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের জন্য বিদ্যালয়টির পরিচিতি রয়েছে। ওল্ড প্লাসিডিয়ান ৮৪ ব্যাচের যাদের নাম আমি বলেছি, তাদের কেউ কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ নামকরা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কেউ খ্যাতিমান নাট্যনির্মাতা, কেউ কেউ বর্তমান সময়ের নামকরা ব্যবসায়ী। সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
জীবনের নানা ঘাটে নোঙর করা এসব লোকজনের জীবনে পালাবদল ঘটেছে। সহপাঠীদের আড্ডায় দূর দেশে দেখা গেল, বন্ধুদের পেয়ে আবার লোকগুলো ফিরে গেছে দুরন্ত শৈশবে। বন্ধুত্বের এমন নির্মল অবগাহন দেখে নিজেই আপ্লুত হই। মনে মনে বলি, ‘জয় হোক বন্ধুত্বের। জয় হোক নির্মলতার!’