
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে ইউক্রেন যেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সহায়তায় তারা সেগুলো ফিরে পেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলছে। গত মঙ্গলবার অধিবেশনের ফাঁকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে তাঁর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়ে দীর্ঘ পোস্ট দেন তিনি। যে পোস্টে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং ইউক্রেন ও ন্যাটোর পক্ষে তাঁর অবস্থানের ইঙ্গিত মেলে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের এ নাটকীয় সুর বদলের কারণ, তাঁর বর্তমান অবস্থান এবং আগে তাঁর অবস্থান কী ছিল, তা বিশ্লেষণ করেছে আল-জাজিরা।
জেলেনস্কির সঙ্গে মঙ্গলবারের বৈঠকের পর নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, ‘আমার মনে হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ইউক্রেন এ লড়াই চালিয়ে নিতে পারবে এবং আগে ইউক্রেনের (ভূখণ্ডের) আকার যেমন ছিল, তার পুরোটার দখল আবার ফিরে পাবে।’
ট্রাম্প তাঁর পোস্টে ন্যাটোর বিষয়েও কথা বলেছেন। অতীতে নানা সময়ে তিনি ন্যাটোর তীব্র সমালোচনা করেছেন। সেদিন ট্রাম্প লেখেন, ‘সময়, ধৈর্য এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক সহায়তা, বিশেষ করে ন্যাটোর সমর্থন নিয়ে ইউক্রেন এই যুদ্ধ যে সীমান্ত থেকে শুরু করেছিল, তাদের সেখানে ফিরে যেতে পারা খুবই বাস্তব একটি বিকল্প।’
একটি সত্যিকারের সামরিক শক্তি এ (ইউক্রেন) যুদ্ধ জিততে এক সপ্তাহের কম সময় নিত।ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট
ট্রাম্প তাঁর পোস্টে রাশিয়ার সমালোচনাও করেছেন। তিনি বলেছেন, রাশিয়া লক্ষ্যহীনভাবে এ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের দেখে ‘কাগুজে বাঘ’ মনে হচ্ছে। কাগুজে বাঘ বলতে এমন ব্যক্তি বা বস্তুকে বোঝানো হয়, যা দেখতে ভয়ংকর মনে হলেও আদতে তেমন কোনো হুমকি তৈরি করতে পারে না।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আক্রমণ করে রাশিয়া। মস্কো এ আক্রমণকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বলে বর্ণনা করেছিল।
ট্রাম্প বলেন, একটি ‘সত্যিকারের সামরিক শক্তি’ এ যুদ্ধ জিততে এক সপ্তাহের কম সময় নিত।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও বলেন, ‘ইউক্রেন তাদের দেশকে মূল আকারে ফেরত নিতে সক্ষম হবে। কে জানে, হয়তো ওই সীমানা ছাড়িয়েও যেতে পারে। পুতিন ও রাশিয়া বড় অর্থনৈতিক সমস্যায় রয়েছে, আর সময় এখন ইউক্রেনের ব্যবস্থা গ্রহণের।’
ট্রাম্প তাঁর পোস্ট শেষ করেন এভাবে, ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে, আমি উভয় দেশের শুভকামনা করি। আমরা ন্যাটোকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখব, ন্যাটো সে অস্ত্র দিয়ে কী করবে, সেটা তাদের বিষয়। সবার জন্য শুভকামনা!’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে জেলেনস্কি লেখেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ় সহযোগিতার সম্পর্কের জন্য আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবে পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন এবং এই যুদ্ধে সব দিক সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত আছেন। এই যুদ্ধ অবসানে অবদান রাখার যে সংকল্প তিনি করেছেন, আমাদের কাছে তা অত্যন্ত মূল্যবান।’
অন্যদিকে ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ গতকাল বুধবার বলেছেন, যে লক্ষ্য নিয়ে ইউক্রেনে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা ও লক্ষ্য অর্জনে রাশিয়া এ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
রাশিয়ার আরবিসি রেডিওতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পেসকভ আরও বলেন, ‘আমরা দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ উভয়ের জন্যই এটি করছি। আগামীর বহু প্রজন্মের জন্য। আমাদের কাছে এর কোনো বিকল্প নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ় সহযোগিতার সম্পর্কের জন্য আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবে পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন এবং এই যুদ্ধে সব দিক সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত আছেন।ভলোদিমির জেলেনস্কি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট
‘আপনার হাতে কোনো কার্ড নেই’ (ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে একটি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করতে হোয়াইট হাউসে ডেকেছিলেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ওই বৈঠকের শুরুতেই যথেষ্ট ‘কৃতজ্ঞতা’ না দেখানোর অভিযোগ তুলে জেলেনস্কিকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন ট্রাম্প ও তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স। বিশেষ করে ভ্যান্স কড়া ভাষায় জেলেনস্কিকে তিরস্কার করেছিলেন।
সেদিন ট্রাম্প এ ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, যুদ্ধ শেষ করতে হলে ইউক্রেনকে তাদের কিছু ভূখণ্ডের দাবি ছেড়ে দিতে হবে। তিনি জেলেনস্কিকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে কৃতজ্ঞ হতে হবে। আপনার হাতে কোনো কার্ড নেই। আপনারা সেখানে চাপা পড়ে গেছেন। আপনার মানুষ মরছে। আপনার সৈন্য সংখ্যা কমে এসেছে।’
সেদিন ট্রাম্প আরও বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়েই জেলেনস্কি ‘কঠোর অবস্থানে’ গিয়েছিলেন। তিনি জেলেনস্কিকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, ‘আপনি লাখ লাখ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছেন। আপনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন। আমি নিশ্চিত, যদি যুক্তরাষ্ট্র জড়িত হয়ও, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত নন।’
‘জমি বিনিময় করতে হবে’ (আগস্ট ২০২৫)
আগস্টে আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলতে শুরু করেন, যুদ্ধের অবসানে ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় দেশকেই ভূমি ছাড়তে হবে।
সে সময় ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সেখানে কিছু ভূমির বিনিময় হতে চলেছে।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেছিলেন, ‘রাশিয়া ইউক্রেনের কিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। আমরা যেগুলোর কিছু ফিরিয়ে দেওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টা করছি।’
যেকোনো পরিস্থিতিতে, আমি উভয় দেশের শুভকামনা করি। আমরা ন্যাটোকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখব, ন্যাটো সে অস্ত্র দিয়ে কী করবে, সেটা তাদের বিষয়। সবার জন্য শুভকামনা!ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট
যুদ্ধের সময় রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের চারটি প্রদেশের বেশ কিছু অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে দখলে নেয়। সেগুলো হলো দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া।
দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে মিলিয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলকে দনবাস অঞ্চল বলা হয়।
রাশিয়া লুহানস্কের পুরোটা এবং দোনেৎস্কের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। দোনেৎস্কের স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোরস্ক শহর এবং আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনের হাতে রয়েছে।
দনবাস একটি ভারী শিল্পাঞ্চল। খনিজসমৃদ্ধ এই অঞ্চলে প্রচুর কৃষিজমিও রয়েছে। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ মারিউপোল বন্দরটিও ওই অঞ্চলে অবস্থিত। এই বন্দর দিয়ে কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করা যায়।
খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে রাশিয়া। জাপোরিঝঝিয়াও একটি শিল্পাঞ্চল। এখানে লোহা, অ্যালুমিনিয়াম ও উড়োজাহাজ নির্মাণ কারখানা রয়েছে। একটি বৃহৎ পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রও রয়েছে।
আমরা দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—উভয়ের জন্যই এটি করছি। আগামী বহু প্রজন্মের জন্য। আমাদের কাছে এর কোনো বিকল্প নেই।দিমিত্রি পেসকভ, ক্রেমলিন মুখপাত্র
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের কথা বলার ধরনে পরিবর্তনের অর্থ হয়তো ওয়াশিংটনের নীতিতে পরিবর্তন আসা নয়। কয়েকজন বিশ্লেষকের মতে, তাঁর নতুন অবস্থান আদতে পুতিনকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে প্রচ্ছন্ন হুমকি।
সম্প্রতি রাশিয়ার ড্রোন ন্যাটো সদস্যভুক্ত কয়েকটি দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। এর প্রতিক্রিয়াতেই হয়তো ট্রাম্প সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ন্যাটোর দৃঢ় জবাব দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রাশিয়ার যুদ্ধবিমান যদি ন্যাটো দেশগুলোর আকাশসীমা লঙ্ঘন করে থাকে, তবে সেগুলো ভূপাতিত করা উচিত হবে কি না, জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার তেমনটা মনে হয়।’
অবশ্য কেউ কেউ এটাও বলছেন, ট্রাম্প খুব সম্ভবত কাউকে খুব একটা উদ্দেশ্য করে এসব বলছেন না।
লন্ডনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের ইউরেশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কিয়ার গাইলস আল-জাজিরাকে বলেন, ট্রাম্প সর্বশেষ যাঁর সঙ্গে কথা বলেন, তাঁর কথাতে সেই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। যদি কেউ এখন ট্রাম্পকে রাশিয়ার পক্ষে বোঝান, তিনি তখনই নিজের মত বদলাবেন।
কিয়ার গাইলস আরও বলেন, ট্রাম্প তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং শব্দগুলো এমনভাবে ব্যবহার করেন, যেন সেগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। তিনি অতীতে একাধিকবার এমনটা করেছেন।
কিয়ার গাইলস আরও বলেন, ‘মানুষ প্রায়ই ভুলে যান যে তিনি (ট্রাম্প) কী বলেন তা নয়, বরং তিনি কী করেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’