ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন ইলন মাস্ক (ডানে)
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন ইলন মাস্ক (ডানে)

ট্রাম্পের জন্য কীভাবে হুমকি হয়ে উঠতে পারে ইলন মাস্কের দল

নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। তাঁর এ উদ্যোগকে ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে সাবেক এই ঘনিষ্ঠ মিত্রের নতুন দল গঠনের বিষয়টিকে ট্রাম্প যতই হাস্যকর বলুন, হতাশ মাস্কই রিপাবলিকান দলের জন্য স্পষ্ট হুমকি হয়ে উঠতে পারেন—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

বিশ্লেষকদের মতে, মাস্কের এ উদ্যোগ যে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের জন্য স্পষ্ট হুমকি হয়ে উঠতে পারে, সেটির পেছনে একটি বড় কারণ, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এখন রিপাবলিকান দল সামান্য ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা টিকিয়ে রেখেছে। কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চকক্ষ সিনেটে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের আসনসংখ্যা যথাক্রমে ২২০–২১২ ও ৫৩–৪৫।

ট্রাম্প সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা একটি বিল সই করেছেন। বিলটি বাজেট–ঘাটতি অনেক বাড়িয়ে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই বিলের তীব্র সমালোচনা করেছেন ধনকুবের ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক।

‘বিগ বিউটিফুল বিল’ নামের ওই বিলে ট্রাম্প স্বাক্ষর করার পরপরই ‘আমেরিকা পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন মাস্ক।

ধনকুবের মাস্কের বিশাল এক অনুসারী গোষ্ঠী রয়েছে, বিশেষ করে মার্কিন কমবয়সী পুরুষদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব তিনি। তাঁরা মাস্ককে একজন ব্যতিক্রমী প্রতিভা ও তারকা হিসেবে দেখেন।

নতুন দলের নীতিগত দিক নিয়ে ইলন মাস্ক এখনো বিস্তারিত কিছু জানাননি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি আগামী বছর কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের কয়েকটি আসন লক্ষ্যবস্তু করবেন; বিশেষ করে সেই সব রিপাবলিকানদের, যাঁরা আর্থিক শৃঙ্খলা বা বাজেট নিয়ন্ত্রণের পক্ষে কথা বলার পরও ট্রাম্পের বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ম্যাট শুমেকার বলেন, ইলন মাস্কের আমেরিকা পার্টি ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে অজানা প্রভাববিস্তারকারী হয়ে উঠতে পারে; বিশেষত রিপাবলিকানদের জন্য।

শুমেকার একসময় রিপাবলিকান দল থেকে কংগ্রেসে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। বর্তমানে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে সামান্য ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রেখেছে। তাই মাস্কের নতুন দল নিয়ে রিপাবলিকানদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্বের শীর্ষ ধনী মাস্ক কয়েক সপ্তাহ ধরে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন। জুনে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক জরিপ চালান। সেখানে ৫৬ লাখ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষই তাঁর এ উদ্যোগকে সমর্থন করেন।

ইলন মাস্কের আমেরিকা পার্টি ২০২৬ সালে কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনে অজানা প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে রিপাবলিকানদের জন্য।
—ম্যাট শুমেকার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা

ধনকুবের মাস্কের বিশাল এক অনুসারী গোষ্ঠী রয়েছে; বিশেষত মার্কিন কম বয়সী পুরুষদের কাছে তিনি দারুণ আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। তাঁরা মাস্ককে একজন ব্যতিক্রমী প্রতিভা ও তারকা হিসেবে দেখেন।

এএফপিকে শুমেকার বলেন, মাস্কের ভাবমূর্তি অসন্তুষ্ট স্বাধীন ভোটার, তরুণ ও প্রযুক্তিনির্ভর ভোটারদের আকর্ষণ করবে। (মাস্কের দল না থাকলে) তাঁরা হয়তো দোদুল্যমান ডিস্ট্রিক্টগুলোতে রিপাবলিকানদের পক্ষে ভোট দিতেন।

ক্ষমতার ভারসাম্যে অর্থ ও খ্যাতির প্রভাব কতটা

মাস্কের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪০৫ (৪০ হাজার ৫০০ কোটি) বিলিয়ন ডলার। এ ধনকুবের ইতিমধ্যেই দেখিয়েছেন, তিনি রাজনীতিতে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে প্রস্তুত। ২০২৪ সালের ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারশিবিরে একাই ২৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছিলেন মাস্ক।

বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক কয়েক সপ্তাহ ধরে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন। জুন মাসে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক জরিপও চালান, যেখানে ৫৬ লাখ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষই তাঁর এ উদ্যোগকে সমর্থন করেন।

তবে উইসকনসিনে সম্প্রতি স্টেট সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে মাস্ক–সমর্থিত প্রার্থী বড় ব্যবধানে হেরে গেছেন। মাস্ক সেখানে নিজের পছন্দের প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে ২ কোটি ডলার খরচ করেন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে রাজনীতিতে অর্থ ও খ্যাতির প্রভাবে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁদের ভোট কেড়ে নেওয়ার মতো কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগে ইলন মাস্ক যুক্ত—এমন কল্পনাও করা কঠিন।
—ফ্লাভিও হিকেল, মেরিল্যান্ডের ওয়াশিংটন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

এ সীমাবদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ—যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্টল্যান্ড’ নামে পরিচিত মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলীয় ও গ্রামীণ অঙ্গরাজ্যগুলোতে নিজের পক্ষে সমর্থন গড়ে তোলা। এসব অঞ্চল মাস্কের সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক ‘টেক ব্রো’ বলয়ের (প্রযুক্তিপ্রেমী ধনিক শ্রেণি) অংশ নয়।

টাইম ম্যাগাজিনের ২০২১ সালের বর্ষসেরা ব্যক্তি ছিলেন ইলন মাস্ক। একসময় মার্কিন জনগণের একটি বড় অংশের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সরকারি ব্যয় হ্রাস প্রকল্পের মধ্যমণি হওয়ার পর তাঁর জনপ্রিয়তা নাটকীয়ভাবে কমে যায়। নানা জরিপে মাস্কের জনপ্রিয়তা হ্রাসের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

টাইম ম্যাগাজিনের ২০২১ সালের বর্ষসেরা ব্যক্তি ছিলেন ইলন মাস্ক। একসময় মার্কিন জনগণের এক বড় অংশের কাছে জনপ্রিয়ও ছিলেন তিনি; কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সরকারি ব্যয় হ্রাস প্রকল্পের মধ্যমণি হওয়ার পর তাঁর জনপ্রিয়তা নাটকীয়ভাবে কমে যায়। নানা জরিপে মাস্কের জনপ্রিয়তা হ্রাসের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

মেরিল্যান্ডের ওয়াশিংটন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফ্লাভিও হিকেল বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই সবকিছু এক পাল্লায় ওজন করতে চাইবেন না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে রিপাবলিকান সমর্থক গোষ্ঠী ও মেগা (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) আন্দোলন বেশ ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, তাদের আলাদা করা কঠিন।’

ট্রাম্পের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক হলেও এখনো নিজ সমর্থকদের তাঁর প্রতি সমর্থন অবিচল আছে বলে মনে করেন হিকেল। তিনি বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁদের ভোট কেড়ে নেওয়ার মতো কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগে ইলন মাস্ক যুক্ত—এমনটা কল্পনাও করা কঠিন।

নতুন দলের উবে যাওয়া

যদিও অনেক রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছেন, জিতেছেনও; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির আধুনিক ইতিহাসে তৃতীয় কোনো দলের জয় বিরল ঘটনা।

ইলনের দল (কংগ্রেসে) কোনো আসন জিততে পারবে না; কিন্তু তাদের কারণে রিপাবলিকানদের মূল্য চোকাতে হতে পারে; বিশেষ করে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ডিস্ট্রিক্টগুলোতে। সেখানে ডানপন্থী (রক্ষণশীল রিপাবলিকান) দলের কাছ থেকে কয়েকটি ভোট কেটে নেওয়া হলেও ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যেতে পারে।
—ইভান নিয়েরম্যান, রেড বানিয়ানের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও

১৯৭০-এর দশকে নিউইয়র্ক স্টেটের কনজারভেটিভ পার্টি ও ১৯৩০-এর দশকে ফার্মার-লেবার পার্টি গত শতকে সিনেটের আসন জিতেছিল। প্রতিনিধি পরিষদেও তাদের সাফল্য উল্লেখ করার মতো নয়।

এ বিষয়ে একাধিক বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে এএফপি। তাঁরা বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থায় তৃতীয় দলের প্রার্থীদের সামনে থাকা প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম স্বাক্ষর সংগ্রহের শর্ত, আবেদনের জন্য নির্ধারিত অর্থ, বয়স, আবাস ও নাগরিকত্ব–সম্পর্কিত কঠোর নিয়মকানুন।

এ কারণে তৃতীয় দলের মার্কিন কংগ্রেসে আসন জেতা বেশ কঠিন হতে পারে বলে একমত বিশ্লেষকেরা। তবে তাঁরা বলছেন, মাস্ক সম্ভাব্য দুর্বল অবস্থানে থাকা বর্তমান রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যদের ভোট কেটে ট্রাম্পকে আঘাত করতে পারেন; অথবা প্রাইমারিতে প্রেসিডেন্টের পছন্দের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পক্ষে অর্থ ব্যয় করতে পারেন।

বৈশ্বিক সংকটবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রেড বানিয়ানের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ইভান নিয়েরম্যান বলেন, ইলনের দল (কংগ্রেসে) কোনো আসন জিততে পারবে না; কিন্তু তাদের কারণে রিপাবলিকানদের মূল্য চোকাতে হতে পারে, বিশেষ করে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ডিস্ট্রিক্টগুলোতে। এসব ডিস্ট্রিক্টে ডানপন্থী (রক্ষণশীল রিপাবলিকান) দলের কাছ থেকে কয়েকটি ভোট কেটে নেওয়া হলেও ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যেতে পারে।