রোজমেরি কুগান
রোজমেরি কুগান

বিবিসির প্রতিবেদন

যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী হিসেবে হয়তো চাঁদে পা রাখবেন রোজমেরি

রোজমেরি কুগানকে ঘিরে আছেন একদল মানুষ। তাঁরা তাঁকে মহাকাশযাত্রীর পোশাক পরিয়ে দিচ্ছেন। পুরো পোশাক পরাতে সময় লাগে প্রায় ৪৫ মিনিট। তারপর তাঁর মাথার ওপর সাবধানে একটা হেলমেট বসিয়ে দেওয়া হয়।

যুক্তরাজ্যের এই মহাকাশচারী এখন তাঁর এযাবৎকালের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাটি দিতে চলেছেন। আদৌ কি তিনি মহাকাশে হাঁটার জন্য প্রস্তুত? পরীক্ষাটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম জলাধারগুলোর একটিতে, যেটা ভরশূন্য ভাসমানতার এক পরীক্ষাগার—নাসার নিউট্রাল বয়ান্সি ল্যাবরেটরি। এটা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টারে অবস্থিত।

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের (আইএসএস) আসল আকারের একটি প্রতিরূপ রয়েছে ১২ মিটার (৪০ ফুট) গভীর এই জলাধারে। এখানে ‘মহাশূন্যে হাঁটার’ যে ধরনের অনুশীলন হয়, সেটি পৃথিবীতে বসে ভরশূন্যতার কাছাকাছি অভিজ্ঞতা।

পানিতে ডুব দেওয়ার আগে রোজমেরি বলেন, আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এমন ডুবে থাকবেন। তিনি বলেন, ‘এটা শারীরিকভাবে ভীষণ কঠিন আর মানসিক দিক থেকেও দারুণ চাপের।’

তবে রোজমেরির মধ্যে তেমন কোনো উদ্বেগের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। তিনি যে প্ল্যাটফর্মটিতে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা যখন ধীরে ধীরে পানির গভীরে নামতে শুরু করে, তখন তিনি হাসিমুখে হাত নাড়ছিলেন।

ড. রোজমেরি কুগান বলেন, ছোটবেলা থেকেই মহাকাশচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তবে সেই স্বপ্ন তখন ছিল অনেক দূরের, ধরাছোঁয়ার বাইরে।

রোজমেরি বলেন, স্কুলের ক্যারিয়ারস ডে বা পেশা দিবসে সাধারণত মহাকাশচারীদের দেখা পাওয়া যায় না। এমন কারও দেখা মেলে না, যিনি বাস্তবে এটা করেছেন। তাঁদের গল্পগুলো শোনারও তেমন সুযোগ পাওয়া যায় না।

এসব ভেবে রোজমেরি তাঁর স্বপ্নের আশা ছেড়ে পড়াশোনা শুরু করলেন তারাদের নিয়ে। বেছে নিলেন অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (জ্যোতির্বিজ্ঞানভিত্তিক পদার্থবিদ্যা)। পরে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) মহাকাশ ভ্রমণের জন্য প্রার্থীর খোঁজে বিজ্ঞপ্তি দিলে রোজমেরি সেখানে আবেদন করেন এবং ২২ হাজারেরও বেশি মানুষের মধ্য থেকে নির্বাচিত হন।

ইএসএর লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে রোজমেরিকে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পাঠানো। ব্রিটিশ মহাকাশচারী হেলেন শার্মানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন রোজমেরি। তিনি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মির স্পেস স্টেশনে গিয়েছিলেন। এই তালিকায় আরও আছেন টিম পিক। তিনি ২০১৫ সালে আইএসএস–এ মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

রোজমেরি ছয় মাস ধরে জনসন স্পেস সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি বিবিসিকে ল্যাবের মডিউলগুলো ঘুরে দেখান। এগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত। মহাকাশচারীরা এসব মডিউলে মাসের পর মাস থাকেন ভাবলে সেগুলো খুব আঁটসাঁট জায়গা বলে মনে হয়। তবে রোজমেরি এ সময় বিবিসিকে বাইরের অসাধারণ দৃশ্যপটের কথা মনে করিয়ে দেন।

‘এটা নিঃসঙ্গ এক পরিবেশ। তবে আমার মনে হয় এতে বাইরের জগতের সঙ্গে একটা মানসিক সংযোগ তৈরি হয়। আবদ্ধ, দম আটকানোর অনুভূতিও অনেকটা কমে যায়।’

প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মহাকাশচারীদের সঙ্গে রোজমেরি কুগান

ওদিকে চৌবাচ্চায় ডুবুরিরা রোজমেরির পানিতে ভেসে থাকার ক্ষমতাকে সমন্বয় করছিলেন, যাতে তিনি ঠিকভাবে ভেসে থাকতে পারেন। মাইক্রোগ্রাভিটির (প্রায় শূন্য মাধ্যাকর্ষণ) সবচেয়ে কাছাকাছি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এমনটা করা হচ্ছে।

এর ব্যাখ্যায় রোজমেরি বলেন, ‘এর জন্য প্রচুর মানসিক প্রস্তুতি লাগে, প্রতিটি পদক্ষেপ আগেভাগেই মাথায় গুছিয়ে নিতে হয়। শক্তি ব্যবহারেও হতে হয় খুব মিতব্যয়ী। এমন কিছু করা যায় না, যাতে পরে ভুল হয়েছে বুঝলে আবার করতে হয়।’

জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির সাবেক স্পেস স্টেশন কমান্ডার আকি হোশিদে রোজমেরির পরামর্শক হিসেবে উপস্থিত আছেন। তিনি মহাশূন্যে চারটি হাঁটা সম্পন্ন করেছেন। তিনি বলেন, মহাশূন্যে হাঁটাটা নতুন মহাকাশচারীদের জন্য কঠিন এক শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতায় উত্তরণ।

হোশিদে বলেন, ‘আমরা যখন এই পথচলা শুরু করি, শুরুতে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ তথ্য এসে পড়ে। দক্ষতামূলক নানা বিষয় শিখতে হয়। সেগুলো দেখাতে ও প্রমাণ করতেও হয়। এটা ধাপে ধাপে এগোনোর মতো। তবে ওরা এগিয়ে চলেছে। যখন ওদের এখানে আসতে দেখি, পুলে ঝাঁপ দিতে দেখি, আমিও ওদের উত্তেজনা অনুভব করতে পারি।’

রোজমেরি  বিবিসির সংবাদদাতাকে একটা স্যাটার্ন ফাইভ দেখাতে নিয়ে যান। ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো মহাকাশচারীদের চাঁদে নিয়ে গিয়েছিল এই রকেট। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পরে নাসা তাদের আর্টেমিস কর্মসূচির মাধ্যমে শিগগিরই চাঁদের মাটিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউরোপীয় মহাকাশচারীরা পরবর্তী মিশনগুলোতে অংশ নেবেন। ৩৫ বছরের মহাকাশজীবনের সম্ভাবনা থাকায় রোজমেরি একদিন হয়তো প্রথম ব্রিটিশ হিসেবে চাঁদের বুকে হাঁটার সুযোগ পেতে পারেন।

রোজমেরি বলেন, ‘এটা ভীষণ রোমাঞ্চকর যে আমরা মানবজাতি হিসেবে আবার চাঁদের দিকে ফিরে যাচ্ছি। আমি যদি কোনোভাবে এর অংশ হতে পারি, তাহলে সেটা আমার জন্য দারুণ আনন্দের হবে।’

পরীক্ষার অংশ হিসেবে রোজমেরি আরেকজন মহাকাশচারীর সঙ্গে স্পেস স্টেশনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের নির্দিষ্ট কিছু কাজ করছেন।

ছয় ঘণ্টা পানির নিচে কঠিন প্রশিক্ষণের পর রোজমেরি যখন তাঁর মহাশূন্যে হাঁটার পরীক্ষাটির শেষ প্রান্তে, ঠিক তখন তাঁকে এক অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হলো। তাঁর সহমহাকাশচারীকে অজ্ঞান হওয়ার ভান করতে বলা হয়েছিল। হয়ে পড়েছেন—এমন অভিনয় করেন। রোজমেরির জন্য কাজ হলো দ্রুত তাঁর কাছে পৌঁছানো, তাঁর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখা এবং এরপর তাঁকে নিরাপদ দরজার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া।

নাসার স্পেসওয়াক দলের প্রশিক্ষক জেনা হ্যানসন বলেন, ‘রোজমেরির ধৈর্য একদম চ্যাম্পিয়নের মতো। আজ সে অসাধারণ করেছে।’

বিবিসিকে হ্যানসন বলেন, ‘উদ্ধার পর্বটা খুব কঠিন হওয়ায় এটা সত্যি চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে দিনটা আসলেই উপভোগ্য ছিল।’

রোজমেরি বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতা অসাধারণ। যদি কখনো সত্যিকারের স্পেস স্টেশনে এসব করতে পারি, যেখানে বাইরে তাকিয়ে পৃথিবীকে দেখা যায়, তারাদের দেখা যায়, তাহলে একেবারে ষোলোকলা পূর্ণ হবে।’