বিশ্বে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল যতই ঘন ঘন হোক, কিছু নেতা আছেন যাঁরা বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে আছেন। নিজেদের ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছেন। আফ্রিকার ছোট-বড় দেশ থেকে শুরু করে রাশিয়ার মতো বিশ্বশক্তি—সবখানেই এমন নেতার দেখা মেলে।
এসব নেতার কেউ কেউ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আছেন, কেউ কেউ দমননীতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছেন, আবার কেউ ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে রাজনৈতিক কৌশল ও সাংবিধানিক সংশোধনীর আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা ১০ রাষ্ট্রনেতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১৯৭৯ সালে এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইকুয়েটরিয়াল গিনির ক্ষমতায় আসেন তেওদোরো ওবিয়াং এনগুয়েমা। এরপর ৪৬ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় টিকে আছেন তিনি। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ারও এক দশক আগে থেকে গিনির শাসনক্ষমতায় আছেন ওবিয়াং।
এনগুয়েমার ৪৬ বছরের শাসনামলে দমনপীড়ন নীতির জন্য তিনি বেশ সমালোচিত হয়েছেন। এ কারণে তাঁর শাসনামলে ইকুয়েটরিয়াল গিনি আফ্রিকার ‘উত্তর কোরিয়া’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন এমন নেতাদের তালিকায় ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়। তিনি ১৯৮২ সালের নভেম্বর থেকে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশের শাসনক্ষমতায় আছেন। অর্থাৎ বিয়া ৪৩ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে আছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানও তিনি।
বর্তমানে পল বিয়ার বয়স ৯২ বছর। ২০১৮ সালের নির্বাচনে টানা সপ্তমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। যদিও ওই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ আছে। পরবর্তী সাত বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন বিয়া।
সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা বর্তমান রাষ্ট্রনেতাদের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছেন ডেনিস সাসু এনগুয়েসো। তিনি মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। সাসু এনগুয়েসো শুরুতে ১৯৭৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
পরে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শেষে ১৯৯৭ সালে এনগুয়েসো আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন এবং তখন থেকে আজ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে আছেন। অর্থাৎ এই নেতা সব মিলিয়ে ৪১ বছর দেশটির শাসনক্ষমতায় আছেন।
টানা পাঁচ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসানের মধ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালে উগান্ডায় ক্ষমতায় বসেছিলেন ইউয়ারি মুসেভেনি। এর পর থেকে ৩৯ বছর ধরে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে আছেন।
মুসেভিনি ২০২১ সালের নির্বাচনে বিতর্কিতভাবে ষষ্ঠ মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হন। আগামী বছর দেশটিতে আবারও নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনেও সপ্তম মেয়াদের জন্য প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মুসেভিনি। বর্তমানে এই নেতার বয়স ৮১ বছর।
তাজিকিস্তানের একটি সমবায় খামারের প্রধান ছিলেন এমোমালি রাহমন। সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙনের পরপরই তিনি দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। ৩৩ বছর ধরে তিনি দরিদ্র ও পাহাড়ি এ দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে এমোমালি রাহমনের বয়স ৭৩ বছর।
সাবেক বিদ্রোহী নেতা ইসাইয়াস আফওয়ারকি ৩২ বছর ধরে হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের দেশ ইরিত্রিয়ার শাসনক্ষমতায় আছেন। ইরিত্রিয়া ১৯৯৩ সালে ইথিওপিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে এই নেতার বয়স ৭৯ বছর।
১৯৯৪ সাল থেকে বেলারুশের রাষ্ট্রপ্রধান আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত বেলারুশের এই শাসক। ৭১ বছর বয়সী আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
সোভিয়েত যুগের দমননীতি ব্যবহার করে লুকাশেঙ্কো ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশ বেলারুশে ৩১ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছেন।
ইসমাইল ওমর গেলে ১৯৯৯ সাল থেকে জিবুতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ ২৬ বছর ধরে তিনি দেশটির শাসনক্ষমতায় আছেন। ২০২১ সালে তিনি পঞ্চম দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০২৬ সালে দেশটিতে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, ৭৫ বছরের বেশি বয়সীদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমানে ওমর গেলের বয়স ৭৮ বছর। গত মে মাসে দ্য আফ্রিকা রিপোর্টের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ২০২৬ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন কি না? জবাবে ওমর গেলে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। তবে ওই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলে তাঁকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
ভ্লাদিমির পুতিন ২৬ বছর ধরে রাশিয়াকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পুতিন ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। পুতিন তখন থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে রাশিয়ার সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী, ওই সময় কোনো প্রেসিডেন্টের পরপর দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালনের সুযোগ ছিল না।
পুতিন তখন প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ করে দেন। ২০১২ সালে পুতিন আবারও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
২০২০ সালে এসে আবারও ধারাবাহিক দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট না থাকার সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়েন পুতিন। তবে তখন তিনি সংবিধান সংশোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর কমপক্ষে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
রুয়ান্ডার সাবেক তুতসি বিদ্রোহী নেতা পল কাগামে ১৯৯৪ সালে তুতসিবিরোধী গণহত্যার অবসানে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেন। এরপর ২০০০ সালের এপ্রিলে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হন।
ওই সময় থেকে মধ্য আফ্রিকার ছোট দেশ রুয়ান্ডার শাসনক্ষমতায় আছেন পল কাগামে। অর্থাৎ পল কাগামে ২৫ বছর ধরে রুয়ান্ডাকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
তথ্যসূত্র: এএফপি, আল–জাজিরা, বিবিসি