ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা কর্মব্যস্ত জীবন শেষে মানুষ একসময় অবসরজীবন শুরু করেন। তবে এখন অবসরজীবন মানে শুধু বিশ্রাম নয়; বরং অনেকে এটি দারুণভাবে উপভোগ করতে চান। কর্মজীবনে ব্যস্ততার কারণে যেসব শখ পূরণ করতে পারেননি, সেগুলো পূরণ করতে নেমে পড়েন। কেউ বেরিয়ে পড়েন ভ্রমণে, কেউ ঝাঁপিয়ে পড়েন শখের কাজে। আবার কেউ রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায়, শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে জীবন কাটাতে পাড়ি দেন অন্য দেশে।
অবসরভোগীদের জন্য কিছু দেশের বিশেষ ভিসা প্রকল্প রয়েছে। এসব দেশ সারা বিশ্বের অবসরভোগীদের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ে মানসম্মত জীবনযাপনের প্রস্তাব দেয়, থাকে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ। এ ধরনের সুবিধা থাকা দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে পর্তুগাল, মরিশাস ও স্পেন।
ভিনদেশের নাগরিকত্ব, ভিসা ও বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস–সম্পর্কিত তথ্য ও পরামর্শ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল সিটিজেন সলিউশনস সম্প্রতি তাদের ‘রিটায়ারমেন্ট রিপোর্ট-২০২৫’ প্রকাশ করেছে। সেখানে অবসরজীবন কাটাতে সেরা ১০ দেশের একটি তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকায় ধরে আজকের শীর্ষ ১০ আয়োজন।
জার্মানি বা ফ্রান্সের মতো ইউরোপের দেশের তুলনায় পর্তুগালে জীবনযাপনের ব্যয় কম। কিন্তু দেশটিতে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রায় ইউরোপের উন্নত দেশের মানের। এ ছাড়া পর্তুগালে দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমোদন রয়েছে। ফলে নিজের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রেখে এখানে নতুন করে জীবন শুরু করা যায়।
এসব কারণে অবসরজীবন উপভোগ করতে বিদেশে যেতে চাওয়া মানুষদের কাছে ইউরোপের এই দেশ আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
বিদেশিদের জন্য পর্তুগালে ডি৭ ভিসা প্রকল্প রয়েছে। যাঁদের নিয়মিত স্থিতিশীল আয় রয়েছে, তাঁরা এ ভিসা নিয়ে দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেন।
বিদেশ থেকে আসা মানুষ যেন দেশটিতে নিজেদের নিরাপদ বলে অনুভব করতে পারেন, সে বিষয়ে পর্তুগাল সরকার বিশেষভাবে নজর দেয়। ডি৭ ভিসার জন্য আবেদন করতে জনপ্রতি ৮৭০ ইউরো আয় দেখাতে হয়। বাংলাদেশি অর্থে যা ১ লাখ ২৪ হাজার টাকার (১ ইউরো সমান ১৪৩ টাকা হিসাবে) কিছু বেশি।
আবেদনের পর ভিসাপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ১২ মাসের মতো লাগে। অন্তত পাঁচ বছরের জন্য ভিসা দেওয়া হয়। এরপর স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়।
তালিকায় ২ নম্বরে আছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মরিশাস। অবসরে যাওয়া কেউ যদি মাসিক ন্যূনতম দেড় হাজার ডলার আয়ের প্রমাণ দেখাতে পারেন, তবে তিনি মরিশাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অনুমতি পাবেন। সাধারণত এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে তিন মাসের মতো লাগে।
মূল আবেদনকারীর সঙ্গে তাঁর জীবনসঙ্গী বা আইনসিদ্ধ সঙ্গী ও সন্তানেরাও বসবাসের অনুমতি পান। মরিশাসে বিদেশ থেকে আসা আয়ে কর দিতে হয় না। নিজের বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের ওপরও কর নেই। ছয় বছর বসবাসের পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতিও আছে দেশটিতে।
তৃতীয় স্থানে স্পেন। দেশটির নন-লুক্রেটিভ ভিসা (এনএলভি) তৈরি করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের নাগরিকদের জন্য, যাঁরা স্পেনে বসবাস করতে চান, কিন্তু কোনো ধরনের কাজ করতে চান না।
এ ভিসার জন্য আবেদন করতে মাসে অন্তত ২ হাজার ৪০০ ইউরো স্থিতিশীল আয় দেখাতে হবে। সাধারণত আবেদনের পর যাচাই–বাছাই করতে তিন মাসের মতো লাগে। ভিসা পাওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে স্পেনের অন্য নাগরিকদের মতো কর দিতে হয়। ১০ বছর বৈধভাবে বসবাসের পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়।
তালিকায় ৪ নম্বরে আছে লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে। অবসরজীবন কাটাতে দেশটিতে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করতে মাসে দুই হাজার ডলার স্থিতিশীল আয় দেখাতে হয়। সাধারণত এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে মাসখানেকের মতো লাগে।
আবেদনকারীর সঙ্গে তাঁর জীবনসঙ্গী বা আইনসিদ্ধ সঙ্গী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ও নির্ভরশীল সন্তানেরাও বসবাস করার অনুমতি পায়। উরুগুয়েতে বিদেশ থেকে আসা আয়ে কর দিতে হয় না। নিজের বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের ওপরও কর নেই। পাঁচ বছর বসবাসের পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতিও আছে।
বিদেশে বসবাসের সময় নিজেদের খরচ চালানোর মতো আয় যাঁদের আছে, এমন ব্যক্তিদের স্বাধীনভাবে বসবাসের অনুমতি দেয় অস্ট্রিয়া। অবসরযাপনের জন্য সেরা গন্তব্যের তালিকায় দেশটি ৫ নম্বরে।
অস্ট্রিয়ায় এমন ভিসা প্রদানপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে চার মাসের মতো লাগে। আবেদনকারীর সঙ্গে তাঁর জীবনসঙ্গী বা আইনসিদ্ধ সঙ্গী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরাও বসবাসের অনুমতি পায়। তবে সেখানে অন্য নাগরিকদের মতো কর দিতে হয়। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের ওপর কর নেই।
১০ বছর বসবাস করার পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতিও আছে।
বিদেশে বসবাসের সময় পর্যাপ্ত আয় আছে, এমন ব্যক্তিদের জন্য ইতালি দেয় ইলেক্টিভ রেসিডেন্সি ভিসা। এ ভিসায় কাজ করার অনুমতি নেই। তবে অবসরজীবন উপভোগ করতে চাওয়া ব্যক্তিদের কাছে এটি জনপ্রিয়। আবেদনকারীর সঙ্গে তাঁর জীবনসঙ্গী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরাও ভিসা পেতে পারে।
সাধারণত ভিসাপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে তিন–চার মাস লাগে। একক আবেদনকারীর মাসে ন্যূনতম ২ হাজার ৬০০ ইউরো ও দম্পতির ক্ষেত্রে প্রায় ৩ হাজার ১০০ ইউরো আয়ের প্রমাণ দেখাতে হয়। নিয়মিত কর দিতে হয়, তবে কোনো সম্পত্তি বা উত্তরাধিকার কর নেই।
টানা ১০ বছর থাকার পর নাগরিকত্বের জন্য ইতালিতে আবেদন করা যায়। দেশটি দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন করে।
যাঁরা নিজেদের খরচ চালানোর মতো পর্যাপ্ত আয় বা সঞ্চয়ের প্রমাণ দিতে পারেন, তাঁদের স্বাধীনভাবে বসবাসের অনুমতি দেয় স্লোভেনিয়া। আবেদনকারীর সঙ্গে জীবনসঙ্গী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরাও সাধারণত আবেদনে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
ভিসাপ্রক্রিয়ার মেয়াদ নথিপত্রের প্রস্তুতি ও যাচাই-বাছাইয়ের ওপর নির্ভর করে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত হতে পারে। আবেদনকারীদের পেনশন, ব্যাংক ব্যালান্স বা নিয়মিত আয়ের দলিল দেখাতে হয়। নিয়মিত করও দিতে হয়।
সম্পদ ও উত্তরাধিকার কর কার্যকর হওয়ার বিষয়টি পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাদা হতে পারে। বসবাসের নির্দিষ্ট মেয়াদ পূরণের পর নাগরিকত্বের আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি আছে।
মাল্টা ভূমধ্যসাগরীয় ছোট দ্বীপ দেশ। এখানকার আবহাওয়া উষ্ণ। লোকজন সাধারণত ইংরেজিতে কথা বলেন। ফলে ইংরেজিভাষী দেশগুলোর মানুষদের কাছে অবসরযাপনের জন্য মাল্টা জনপ্রিয়।
মাল্টায় স্বাস্থ্যসেবার মান বেশ ভালো, জীবনধারা মানসম্পন্ন, জনজীবনে নিরাপত্তাও রয়েছে। এর ওপর পশ্চিম ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় জীবনযাপনের ব্যয় কম। চার সদস্যের একটি পরিবার অনায়াসে আড়াই থেকে তিন হাজার ইউরোর মধ্যে ভালোভাবে জীবন চালিয়ে নিতে পারে।
অবসরভোগীদের জন্য মাল্টায় সুনির্দিষ্ট কোনো ভিসা প্রকল্প নেই। তবে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বসবাসের ভিসার জন্য আবেদন করা যায়।
আবেদনকারীর সঙ্গে জীবনসঙ্গী বা আইনসিদ্ধ সঙ্গী ও সন্তানেরাও বসবাসের অনুমতি পান। বিদেশ থেকে আসা আয়ে মাল্টায় কোনো কর দিতে হয় না। ছয় বছর বসবাস করার পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি রয়েছে।
বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী উত্তর ইউরোপের ছোট দেশ লাটভিয়া। এখানে জীবনযাপনের ব্যয় তুলনামূলক কম। শান্ত শহরগুলো প্রকৃতিকে দারুণভাবে ধারণ করে। স্বাস্থ্যসেবার মান ভালো ও বাসিন্দারা নিরাপদ বোধ করেন। এ কারণে বিদেশিদের কাছে অবসরযাপনের জন্য দেশটি দারুণ পছন্দের।
তবে অবসরভোগীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ভিসা প্রকল্প নেই। পর্যাপ্ত আয় দেখানোর মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়। এ ছাড়া ন্যূনতম ৫০ হাজার ইউরো বিনিয়োগের মাধ্যমে পরিবারসহ ‘গোল্ডেন ভিসার’ আবেদন করা যায়।
লাটভিয়ার ভিসা নিয়ে শেনজেন অঞ্চলে (ইউরোপের ২৬টি দেশ) ভ্রমণ করা যায়। ভিসা আবেদনপ্রক্রিয়া সহজ ও একবারে পাঁচ বছর বসবাসের জন্য ভিসা পাওয়া যায়।
চিলির দীর্ঘ উপকূল রেখা রয়েছে। লাতিন আমেরিকার দেশটির আবহাওয়া রৌদ্রোজ্জ্বল, সৈকতগুলো সুন্দর। পর্যাপ্ত আয়ের প্রমাণ দেখিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করা যায়, ভিসাপ্রক্রিয়ায় ছয় মাসের মতো লাগে।
আবেদনকারীর সঙ্গে তাঁর জীবনসঙ্গী ও সন্তানেরা বসবাসের অনুমতি পান। বিদেশ থেকে আসা আয়ে কর দিতে হয় না। ছয় বছর বসবাস করার পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি আছে।
{তথ্যসূত্র: ফরচুন ডটকম}