সত্য প্রকাশে অবিচল থাকার প্রত্যয়

সুহৃদ, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে ঢাকায় আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রীতিসম্মিলনী।

নারী ফুটবলারদের উন্নয়নে এবং সাফজয়ী নারী দলের হাতে সব মিলিয়ে তুলে দেওয়া হলো দেড় কোটি টাকা। প্রথম আলোসহ অনুদানের সহযোগী সবাই এক মঞ্চে উঠলেন সাবিনাদের সঙ্গে। গতকাল রাজধানীর র‌্যাডিসন ব্লু হোটেলে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

পাঠক ও কর্মীদের নিয়ে প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ধারাবাহিক আয়োজন শুরু হয়েছে আগেই। জেলায় জেলায় আয়োজন করা হচ্ছে সুধী সমাবেশসহ নানা অনুষ্ঠানের। এরই অংশ হিসেবে গতকাল শনিবার সুহৃদ, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে ঢাকায় আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রীতিসম্মিলনী।

রাজধানীর র‌্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে এ প্রীতিসম্মিলনীর আয়োজন করা হয়। হেমন্তের সন্ধ্যায় পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও গল্পে উপভোগ্য সময় কাটান অতিথিরা। বিশিষ্টজনদের সামনে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশে অবিচল থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।

আরও পড়ুন
অনুষ্ঠানে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদের সঙ্গে হাত মেলান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

প্রথম আলো ‘সত্যে তথ্যে ২৪’ আহ্বান নিয়ে ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। গতকাল প্রীতিসম্মিলনীতে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, বিদেশি কূটনীতিক, পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নারীনেত্রী, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্যবসায়ীদের একাংশ।

মন্ত্রীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ।

রাজনীতিবিদদের মধ্যে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক, বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ, রুমিন ফারহানা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন
অনুষ্ঠানের সামনের সারির বাঁ দিকে বসেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা।

কূটনীতিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম টোস্টার, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত অ্যানি ভন লুইয়েনম, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি শুয়ার্ড, ফ্রান্সের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত গিয়াম আউদ্রে দু কেদরে ও তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, ফিলিস্তিন, নেপাল এবং ইউনিসেফ ও আইএলওর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বিশিষ্ট আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী ও গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ আইরিন খান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন এবং ব্যবসায়ী আনিস উদ দৌলা, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন, গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান উপস্থিত ছিলেন।

সাবেক সচিবদের মধ্যে ছিলেন ইনাম আহমেদ চৌধুরী, আলী ইমাম মজুমদার, ফারুক সোবহান ও মো. তৌহিদ হোসেন।

আরও পড়ুন
প্রীতিসম্মিলনীতে উপস্থিত ছিলেন বিদেশি কূটনীতিকেরা। তাঁদের সঙ্গে ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান (ছবির বাঁ থেকে চতুর্থ)
ছবি: দীপু মালাকার

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত, টিআইবির চেয়ারপারসন পারভীন হাসান, অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ, শিল্পী রফিকুন নবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সমকাল–এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ প্রমুখ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকসহ কয়েক জন পুলিশ কর্মকর্তাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অভিনয় শিল্পী মেহজাবীন, আজমেরী হক বাঁধনসহ সুধীজনেরা।

প্রীতিসম্মিলনীতে অতিথিরা আসতে শুরু করেন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকেই। তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা। অতিথিরা যাতে পরিচিতজনদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও আলাপচারিতার সুযোগ পান, সে জন্য মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে অনেকটা সময় রাখা হয়েছিল। সেই সুযোগ নিয়ে বিশিষ্টজনেরা আড্ডা, গল্পে সময় কাটান।

প্রীতিসম্মিলনীর মূল পর্ব শুরু হয় যন্ত্রসংগীতের মনোরম সুরের মধ্য দিয়ে। শিল্পীদের বাঁশির সুর, ঢোলের তাল আর দোতারার ছন্দ উপভোগ করেন অতিথিরা। সুরসংগীতটি কম্পোজ করেছেন ইমন চৌধুরী। পরিবেশন করেন আনন্দ, সজল ও সাইদুজ্জামান সুমন। এরপর ইমন চৌধুরীর সংগীত আয়োজনে শাহ আবদুল করিমের গান গেয়ে শোনান শিল্পী বগা তালেব। ‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি’ গানে কণ্ঠ মেলান অন্তরা, মৌসুমী ও ইনিমা।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সুধীজনের একাংশ।

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কাজ উপলক্ষে সম্প্রতি কুড়িগ্রামের প্রথম আলো চর ও কুষ্টিয়ার কুমারখালী গিয়েছিলেন সম্পাদক মতিউর রহমান। পর্দায় ভেসে ওঠে কুড়িগ্রাম ও কুষ্টিয়া নিয়ে তৈরি ভিডিও চিত্র। ১৯৯৯ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি এলাকা কীভাবে ‘প্রথম আলো চর’ নামে গড়ে উঠল, সেই গল্প শোনান মতিউর রহমান। সেই চরে ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে গিয়েছিল প্রথম আলো ও প্রথম আলো বন্ধুসভা। দুই দশক ধরে ওই চরে মানুষের জীবনের জয়গানের সঙ্গে রয়েছে প্রথম আলো। চরটিতে ২০০৪ সালে ‘আলোর পাঠশালা’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রথম আলো। দেশের দুর্গত এলাকায় এমন ছয়টি স্কুল পরিচালনা করছে প্রথম আলো ট্রাস্ট।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সুধীজনের একাংশ।

কুমারখালী থেকে ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, পত্রিকাটির ছাপাখানায় দাঁড়িয়ে মতিউর রহমান বলছেন, গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় ব্রিটিশ প্রশাসন আর জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখা হতো। এই সত্য প্রকাশের জন্য পত্রিকাটির বিরুদ্ধে হামলা হতো, আক্রমণ হতো। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়িয়েছিল। লালন সাঁই তাঁর দলবল নিয়ে এসে প্রতিরোধ করেছিলেন। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার প্রকাশনা বারবার বন্ধ হয়েছে, শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারেনি।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ সুধীজনের একাংশ।

সত্য তথ্য গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে

ভিডিও চিত্রটি শেষে সরাসরি মঞ্চে আসেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, সত্য তথ্য গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। তাতে দেশ এগিয়ে যায়, মানুষের জয় হয়। প্রথম আলো সব সময় সত্য প্রকাশ করে। তিনি আরও বলেন, সারা পৃথিবীতেই সংবাদমাধ্যমকে লড়তে হচ্ছে সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা আদায়ে। এখনই সাংবাদিকতার সময়। প্রথম আলো সত্য প্রকাশে অবিচল থাকবে।

অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে মঞ্চে আসেন ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান। তিনি ট্রান্সকমের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের স্মরণে প্রবর্তিত সাংবাদিকতায় ‘লতিফুর রহমান পুরস্কার’-এর ক্রেস্ট, সনদ ও পাঁচ লাখ টাকার চেক তুলে দেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের হাতে। গত বছর এ পুরস্কার চালু হয়।

আরও পড়ুন
বক্তব্য দিচ্ছেন মিডিয়াস্টার লিমিটেড ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিমিন রহমান।

বক্তব্যের শুরুতে প্রয়াত লতিফুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান। তিনি বলেন, তাঁর বাবা ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিবছর চেয়ে থাকতেন। প্রথম আলোর প্রতি ছিল তাঁর অন্য রকম ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা ছিল আবেগ ও দেশপ্রেমের।

সিমিন রহমান বলেন, ২৪ বছর ধরে প্রথম আলো বাংলাদেশের মানুষের বস্তুনিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করছে। প্রথম আলো আপসহীন এবং সত্যনিষ্ঠার চর্চা করে। এ কারণে প্রথম আলো পাঠকের অগাধ আস্থা অর্জন করেছে। প্রথম আলো নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হবে, কিন্তু তার বার্তাটি স্থির থাকবে; সেটি হলো আলোর বার্তা, আলোকিত বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জয়, বাংলাদেশের মানুষের জয়।

আরও পড়ুন
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামসহ অতিথিদের একাংশ।

প্রীতিসম্মিলনীতে এবার সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে সম্মাননা জানানো হয়। চ্যাম্পিয়ন দলের ২৩ জন খেলোয়াড় এবং কোচ, সহকারীসহ ৩০ জনের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় এক লাখ টাকার চেক। পাশাপাশি নারী ফুটবলের উন্নয়নে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে) দেওয়া হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এই দেড় কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে প্রথম আলোর উদ্যোগে। অনুদান দিয়েছেন ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে নিয়ে প্রথম আলোর উদ্যোগে রেদওয়ান রনির তৈরি ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।

এ পর্বের মাধ্যমে প্রীতিসম্মিলনীর অনুষ্ঠান শেষ হয়। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক অতিথিদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান।

আরও পড়ুন