‘দেখতে দেখতে গাড়িটা আমাদের ওপরে উঠে গেল। এরপরে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন শরীরে অসহ্য ব্যথা। হাত-পা অবশ। এখন তো হাসপাতালে।’ বম ভাষায় এভাবেই গতকাল সোমবার দুপুরে বান্দরবানের রুমা-বগালেক সড়কে ঘটে যাওয়া দুই ট্রাকের সংঘর্ষের বর্ণনা দিলেন জিরনুনময় বম (২৬) নামের একজন।
মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে মেঝেতে চিকিৎসাধীন জিরনুনময়ের সঙ্গে দোভাষীর সাহায্যে কথা হয়।
সোমবার বেলা দেড়টার দিকে পাহাড়ি নারী-পুরুষদের নিয়ে একটি ট্রাক বগালেক থেকে রুমার উপজেলা সদরের দিকে যাচ্ছিল। রুমা থেকে আরেকটি ট্রাক বগালেকের দিকে যাচ্ছিল। পথে দুটি ট্রাক কমলাবাজার ও বগালেকের মাঝামাঝি এলাকায় এলে একটি ট্রাক আরেকটি ট্রাকের ওপর উঠে যায়। রুমাগামী ট্রাকটিতে যাত্রী ছিলেন আনুমানিক ২০ জন।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনকে রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের মধ্যে ৯ জন নারী ও এক শিশু। চিকিৎসা নিয়ে আজ একজন হাসপাতাল ছেড়েছেন। চিকিৎসাধীন আছেন ৯ জন। এর মধ্যে অন্তত ৫ জন মাথায় আঘাত পেয়েছেন। দুজনের হাত ও পা ভেঙেছে। অন্যদের আঘাত তুলনামূলক কম।
কর্তব্যরত এক চিকিৎসক জানান, কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। তবে যাঁরা মাথায় আঘাত পেয়েছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
জিরনুনময় বম দুর্ঘটনায় বেঁচে গেলেও চিকিৎসার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। তাঁর স্বামী কাঠমিস্ত্রি। সব সময় কাজও থাকে না। স্বামীকে আর্থিকভাবে কিছুটা সহযোগিতা করতে তিনি কৃষিকাজ করতেন। এখন ডান পা ভেঙে যাওয়ায় আবার কবে চাষাবাদ শুরু করতে পারবেন, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি। সংসারের খরচ কীভাবে চলবে, সে কথা বলতে বলতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে জিরনুনময়ের।
জিরনুনময়ের পাশের শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছেন দুর্ঘটনায় আহত আরেক নারী লালপিয়ান কিম বম (৫১)। তাঁর বোন পারকুংময় বমও (৪৯) আহত হয়েছেন। জুমচাষি লালপিয়ান বমের আয়ে চলে তাঁর পুরো পরিবার। স্বামী কিছু করেন না। ছেলে প্রতিবন্ধী। দুর্ঘটনায় বাঁ হাত ও ডান পা ভেঙে গেছে তাঁর। আঘাত পেয়েছেন শরীরের অন্য অংশেও। আর্থিক দুরবস্থার কারণে চিকিৎসা খরচ জোগানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে তাঁর। এখন শরীরের চেয়ে বড় প্রশ্ন সামনের দিন কীভাবে চলবেন, সেই দুশ্চিন্তা।
হতাহত ব্যক্তিরা সবাই রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের বাসিন্দা। তাঁরা ট্রাকে করে রুমা উপজেলা সদরে যাচ্ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের কেউ আগে চট্টগ্রামে আসেননি। এখানে নেই আত্মীয়স্বজন। এমন অবস্থায় তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন চট্টগ্রাম ও বান্দরবান শহরে থাকা বম সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা। তাঁরাই এখন দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার খরচ জোগাচ্ছেন। একই সঙ্গে হাসপাতালে থেকে তাঁদের দেখভাল করার কাজটিও করছেন তাঁরা।
এই তরুণদের একজন জিং থান বম। বান্দরবানের রুমা হোস্টেলের এই সুপারিনটেনডেন্ট প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিরা বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন। তাঁরা বান্দরবান শহরেও খুব একটা আসেন না, চট্টগ্রাম তো অনেক দূরের বিষয়। তাই দুর্ঘটনার খবর শুনে তিনি প্রথমে বান্দরবানে ছুটে যান। ঘটনাস্থল থেকে আহত ব্যক্তিদের নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এখানে আরও আট তরুণ-তরুণী যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা পালাক্রমে হাসপাতালে রোগীদের পাশে আছেন।
মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের সঙ্গে এই প্রতিবেদক যখন কথা বলছিলেন, তখন সেখানে আসতে থাকেন একের পর এক বম তরুণ-তরুণী। তাঁদের কেউ আহত ব্যক্তিদের জন্য নিয়ে এসেছেন পোশাক, কেউ রোগীদের জন্য ফল কিংবা অন্যান্য খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
হাসপাতালে আহত টিয়ান হেই বম ও তাঁর মেয়ে জিংরাম সিয়াম বমের পাশে ছিলেন তরুণ পালিয়ান বম। মা-মেয়ে দুজনই মাথাসহ শরীর বিভিন্ন অংশে আঘাত পেয়েছেন। ব্যথার যন্ত্রণায় কথা বলতে পারছিলেন তাঁরা। পালিয়ান বম বলেন, আহত ব্যক্তিদের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। সবাই জুমচাষি। বাড়তি কোনো আয়ও নেই। চিকিৎসার খরচ মেটানো সম্ভব নয়। তাই আপাতত তাঁরা বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করছেন।