‘চুরির অভিযোগে দুই হাত কেটে ফেলবে সৌদি পুলিশ, দ্রুত টাকা পাঠাও’
সৌদিপ্রবাসী বাবার সঙ্গে যে ইমো আইডিতে মেয়ের নিয়মিত যোগাযোগ হয়, সেখান থেকেই বার্তা এল, ‘চুরির অভিযোগে দুই হাত কেটে ফেলবে সৌদি পুলিশ, দ্রুত টাকা পাঠাও’। বাবার এমন খবর পাওয়ার পর দ্রুত ইমোতে দেওয়া বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন মেয়ে।
কয়েক ঘণ্টা পর ওই প্রবাসী বাবা তাঁর মেয়ের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বলেন, তাঁর ইমো আইডি হ্যাক করা হয়েছে। কেউ যোগাযোগ করলে কোনো ধরনের লেনদেন যাতে না করেন। কিন্তু ততক্ষণে প্রতারক চক্র এক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
মূলত ওই সৌদিপ্রবাসীর মুঠোফোনের ইমো অ্যাপ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাঁর মেয়েকে বার্তা পাঠিয়েছিল প্রতারকেরা। জরুরি ভিত্তিতে বিকাশে এক লাখ টাকা পাঠানোর কথা বলেছিল প্রতারক চক্রটি। এ রকম ঘটনা দু-একটি নয়। এ নিয়ে গড়ে ওঠা চক্রটি একের পর এক প্রবাসী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ইমো হ্যাকিংয়ের চক্র গড়ে উঠেছে। এ ধরনের বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেল করেও তারা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
লালপুর ও বাঘায় হ্যাকিং চক্র, গ্রেপ্তার দুজন রাবি শিক্ষার্থী
এক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় চলতি মাসের শুরুর দিকে ঢাকার খিলগাঁও থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী ওই নারী। তদন্তে নেমে ১২ নভেম্বর পুলিশের সিটিটিসি ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ রাজশাহী ও নাটোর থেকে একটি চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে সাকিব খান ও রেজোয়ান আহমেদ নামের দুজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, গত তিন বছরে ইমো আইডি হ্যাক করে প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ৩০ জনের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছেন তাঁরা। তাঁদের অধিকাংশেরই বাড়ি নাটোরের লালপুর ও রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। এই দুই উপজেলায় ইমো হ্যাকিংয়ে অনেক চক্র গড়ে উঠেছে।
সর্বশেষ গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে সাকিবের বাড়ি নাটোরের লালপুরে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশি এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে চক্রটি। ইমো হ্যাক চক্রের অন্যতম হোতা হিসেবে পরিচিত লালপুরের দুড়দুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম এখন কারাগারে।
এডিসি নাজমুল ইসলাম বলেন, নাটোরের লালপুর ও রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ইমো হ্যাকিং চক্র গড়ে উঠেছে। আগে এ প্রতারণায় স্বল্পশিক্ষিত লোকজন জড়িত ছিল। তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।
ইমো আইডি হ্যাক করা হয় যেভাবে
সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের কর্মকর্তা বলেন, ইমো আইডি হ্যাক করতে প্রকৃত মুঠোফোন নম্বরে একটি ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) পাঠায় প্রতারক চক্র। কৌশলে সেই ওটিপি নম্বরটি চক্রের সদস্যরা হাতিয়ে নিয়ে আইডির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে তারা কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করে।
একটি কৌশল হচ্ছে, লক্ষ্যবস্তু বানানো ব্যক্তিকে ইমোর আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয়ে ফোন করা হয়। বলা হয়, আইডিটি ভুয়া বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ জন্য একটি নম্বর পাঠানো হবে। সেই নম্বরটি ইমোর কথিত কর্মকর্তাকে জানানোর পরই তাঁরা নিশ্চিত হবেন আইডিটি ভুয়া নয়।
আরেকটি কৌশল হলো, একজন প্রবাসীর মুঠোফোনে স্বজনের পরিচয় দিয়ে খুদেবার্তা পাঠিয়ে বলা হয়, ইমো নম্বরে কল যাচ্ছে না। বলা হয়, তাঁর মুঠোফোনে একটি নম্বর যাবে, সেটি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে।
ইমো আইডির নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর চক্রের সদস্যরা ইমোর বার্তা আদান-প্রদান এবং কাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, সেটি পর্যালোচনা করে। তারপর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের ইমো আইডিতে বার্তা পাঠিয়ে বিপদে পড়ার কথা বলা হয়।
এসব ক্ষেত্রে কখনো বলা হয়, বিদেশে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন; ছাড়া পেতে টাকার প্রয়োজন। আবার কখনো বলা হয়, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন, দ্রুত টাকা লাগবে। প্রবাসীদের স্বজনদের ইমো আইডি হ্যাক করে প্রবাসীকে বার্তা পাঠানো হয়। বলা হয়, তাঁর কোনো স্বজন দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, দ্রুত টাকার প্রয়োজন।
সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম বলেন, ইমোতে অনেকেই ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে একান্ত মুহূর্তের অনেক ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করে থাকেন। আইডি হ্যাক করার পর এসব ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়েও অর্থ আদায় করে থাকে প্রতারক চক্র।
লক্ষ্যবস্তু কেন ইমো আইডি
মুঠোফোনের অ্যাপসভিত্তিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ইমো। এই অ্যাপের মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদান ও কথা বলার পাশাপাশি ভিডিও কল করা যায়। এটি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। কারণ, কম গতির ইন্টারনেটে প্রত্যন্ত গ্রামেও এই অ্যাপে নির্বিঘ্নে কথা বলা যায়।
ইমো অ্যাপ ব্যবহারও খুবই সহজ। এ কারণে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে ব্যবহারকারীরা এতটা সচেতন নন। তাঁদের প্রযুক্তিজ্ঞানও অনেক কম। এ কারণে চক্রের সদস্যরা ইমো ব্যবহারকারীদেরই লক্ষ্যবস্তু বানান।
এডিসি নাজমুল ইসলাম বলেন, ওটিপি পাঠিয়ে চক্রগুলো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার চেষ্টা করে। ওটিপি কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। কোনো আত্মীয় কোনো সাহায্য চাইলে সেটি যাচাই করে নিতে হবে। মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হতে হবে, ইমোতে যোগাযোগকারী ব্যক্তিটি ভুয়া কি না।তিনি আরও বলেন, একটি ইমো আইডি একাধিক ডিভাইসে লগইন করা যায়। এ কারণে সেটিংস অপশনে গিয়ে দেখতে হবে, কারও ইমো আইডি ‘মাল্টিপল ডিভাইসে লগইন’ করা আছে কি না। থাকলে সেগুলো বন্ধ করে (লগ আউট) দিতে হবে।