এবার পদ্মা ও মেঘনা কোম্পানিতে ডিজেল ‘গায়েব’, দেড় লাখ লিটার গেল কোথায়

কোলাজ: প্রথম আলো গ্রাফিকস

যমুনার পর এবার পদ্মা ও মেঘনা তেল কোম্পানিতে ডিজেলের ঘাটতি পাওয়া গেছে। এই দুই কোম্পানিতে ‘গায়েব’ হয়ে গেছে প্রায় দেড় লাখ লিটার ডিজেল।

চট্টগ্রাম থেকে পাইপলাইনে সরবরাহ করার পর এই দুই কোম্পানির নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে এসে কমে গেছে ডিজেল। এখন তেল মজুতের ট্যাংক ও পাইপলাইনে যুক্ত থাকা মিটারে ত্রুটি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে কর্তৃপক্ষ।

জ্বালানি তেল আমদানি-সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিপিসির অধীন পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানি পরিবেশকের মাধ্যমে বাজারে তেল বিক্রি করে। বিপিসি সূত্রে ডিজেল ঘাটতির এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ডিপো-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিপোতে জ্বালানি তেল পরিমাপ করা হয় সনাতনী প্রক্রিয়ায়। একটি রড (ডিপ স্টিক) দিয়ে মূলত ট্যাংকের গভীরতা মাপা হয়। এই গভীরতা দুই মিলিমিটার কম দেখাতে পারলেই ১ হাজার ১৮০ লিটার পর্যন্ত তেল চুরি করা যায়।

বিপিসি সূত্র বলছে, পাইপলাইনের চট্টগ্রাম ও ঢাকা (নারায়ণগঞ্জ) প্রান্তে মিটার আছে। এ ছাড়া তেল কোম্পানি ও পাইপলাইন কোম্পানির কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বিপিসির নিয়োগ করা বেসরকারি সার্ভে কোম্পানির মাধ্যমে ডিপোর ট্যাংকে থাকা তেল মাপা হয়।

আরও পড়ুন

ডিপো-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিপোতে জ্বালানি তেল পরিমাপ করা হয় সনাতনী প্রক্রিয়ায়। একটি রড (ডিপ স্টিক) দিয়ে মূলত ট্যাংকের গভীরতা মাপা হয়। এই গভীরতা দুই মিলিমিটার কম দেখাতে পারলেই ১ হাজার ১৮০ লিটার পর্যন্ত তেল চুরি করা যায়। আগে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ফতুল্লার দুই ডিপোতে সক্ষমতা বাড়তি দেখানোয় ট্যাংকের গভীরতা মাপার সময় তেলের হিসাব কম পাওয়া গিয়েছিল। আসলে তেল ট্যাংকের ভেতরেই ছিল। এখন পদ্মা ও মেঘনার ক্ষেত্রে ট্যাংকের সক্ষমতা আবার যাচাই করা হলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে।

পাইপলাইনে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে। তাই ঘাটতির কারণ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। দুই প্রান্তের মিটার বা ট্যাংকের সক্ষমতায় ত্রুটি থাকতে পারে। আবার শীতে তাপমাত্রা কমায় তেলের ঘনত্ব কমে ঘাটতি হতে পারে। এগুলো যাচাই করা হচ্ছে।
মো. শাহীরুল হাসান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড

জ্বালানি তেল চুরি ও অপচয় রোধে চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইন নির্মাণ করেছে সরকার। এই পাইপলাইনে পরীক্ষামূলক তেল সরবরাহ চালু হয় গত জুনে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার মূল টার্মিনাল থেকে সরাসরি ডিজেল আসছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও গোদনাইলে।

যমুনার ডিপো ফতুল্লায়। আর পদ্মা ও মেঘনার ডিপো গোদনাইলে। ডিপো-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাইপলাইনে তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় রকমের ঘাটতি হওয়ার সুযোগ নেই। তবে তাপমাত্রার কারণে কিছুটা কমবেশি হতে পারে।

আরও পড়ুন

‘তেল গায়েবের সুযোগ নেই’

বিপিসি সূত্র বলছে, মেঘনার ডিপোতে পাইপলাইনে তেল আসে গত ১০ নভেম্বর। সাধারণত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ধরে জ্বালানি তেল পরিমাপ করা হয়। এ হিসাবে চট্টগ্রাম থেকে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৭২৪ লিটার তেল সরবরাহ করা হয়। ডিপোর ট্যাংকে মেপে পাওয়া যায় ২৪ লাখ ২২ হাজার ৪৭৩ লিটার। অর্থাৎ ঘাটতি পাওয়া যায় ১ লাখ ১৫ হাজার ২৫১ লিটার। এর মানে ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি। যদিও পাইপলাইনে তেল আসার ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া পাইপলাইনের বাইরে তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে সব মিলে শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি অনুমোদন করে বিপিসি।

এ বিষয়ে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহীরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, পাইপলাইনে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে। তাই ঘাটতির কারণ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। দুই প্রান্তের মিটার বা ট্যাংকের সক্ষমতায় ত্রুটি থাকতে পারে। আবার শীতে তাপমাত্রা কমায় তেলের ঘনত্ব কমে ঘাটতি হতে পারে। এগুলো যাচাই করা হচ্ছে।

বিপিসি সূত্র বলছে, মেঘনার ডিপোতে পাইপলাইনে তেল আসে গত ১০ নভেম্বর। সাধারণত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ধরে জ্বালানি তেল পরিমাপ করা হয়। এ হিসাবে চট্টগ্রাম থেকে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৭২৪ লিটার তেল সরবরাহ করা হয়। ডিপোর ট্যাংকে মেপে পাওয়া যায় ২৪ লাখ ২২ হাজার ৪৭৩ লিটার। অর্থাৎ ঘাটতি পাওয়া যায় ১ লাখ ১৫ হাজার ২৫১ লিটার।

বিপিসি সূত্র বলছে, ১১ নভেম্বর পদ্মার ডিপোতে ডিজেল সরবরাহ করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে ২৫ লাখ ২০ হাজার ৭৭০ লিটার ডিজেল সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ডিপোতে মেপে পাওয়া যায় ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৬৮ লিটার। অর্থাৎ ঘাটতি আসে ২৭ হাজার ৩০২ লিটার।

তবে পদ্মা অয়েল পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাইপলাইনের দুই প্রান্তের মিটারের হিসাবে ১ হাজার ৮০০ লিটার তেল বাড়তি আছে। শীতে তাপমাত্রা কমায় ট্যাংকে মাপার পর কমতে পারে। পাইপলাইনে নিয়মিত তেল সরবরাহ শুরু হলে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে।

পাইপলাইনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি তেল পরিবহনে ২০১৬ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল বিপিসি। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। কিন্তু তিন দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর প্রকল্পের কাজ শেষ হয় চলতি বছরের মার্চে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। পাইপলাইন পরিচালনার জন্য পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানি (পিটিসি) পিএলসি নামের একটি কোম্পানি করেছে বিপিসি।

আরও পড়ুন

বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, পাইপলাইন এখনো প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এটি বুঝিয়ে দেওয়ার পর দুই পাশের মিটারের মাধ্যমে তেল বুঝে নেবে বিপণন কোম্পানি।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. আমিনুল হক বলেন, পাইপলাইনে তেল গায়বের সুযোগ নেই। পদ্মা-মেঘনার তেলও সরবরাহ লাইনের কোথাও না কোথাও আছে। এটি ধরা পড়বেই। মিটার রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। মিটার ঠিকঠাক হলে তিন কোম্পানির ট্যাংকের সক্ষমতাও যাচাই করা হবে। এগুলো শেষ হলে পাইপলাইন বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এতে আরও দুই মাস লাগতে পারে।

পাইপলাইনের দুই প্রান্তের মিটারের হিসাবে ১ হাজার ৮০০ লিটার তেল বাড়তি আছে। শীতে তাপমাত্রা কমায় ট্যাংকে মাপার পর কমতে পারে। পাইপলাইনে নিয়মিত তেল সরবরাহ শুরু হলে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে।
মো. মফিজুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পদ্মা অয়েল পিএলসি

যমুনায় ধারণক্ষমতা বেড়েছে ৭৭ হাজার লিটার

যমুনার ফতুল্লা ডিপোতে তেলের ঘাটতি পাওয়া গিয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে। এ বিষয়ে ‘সরকারি তেলের ডিপো থেকে পৌনে ৪ লাখ লিটার ডিজেল গায়েব’ শিরোনামে গত ১ অক্টোবর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। প্রতিবেদনে ট্যাংকের সক্ষমতা নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ উঠে আসে।

আরও পড়ুন

অভিযোগ খতিয়ে দেখতে যমুনা ও পাইপলাইন কোম্পানির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটি নতুন করে ফতুল্লা ডিপোর দুই ট্যাংকের সক্ষমতা যাচাই করে। এতে দুটি ট্যাংক মিলে ৭৭ হাজার ৪৯২ লিটার ধারণক্ষমতা বেড়ে যায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, এর মানে তেল চুরি করতে শুরুতে সক্ষমতা কমিয়ে দেখানো হয়েছিল।

বিপিসি সূত্র বলছে, ১১ নভেম্বর পদ্মার ডিপোতে ডিজেল সরবরাহ করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে ২৫ লাখ ২০ হাজার ৭৭০ লিটার ডিজেল সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ডিপোতে মেপে পাওয়া যায় ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৬৮ লিটার। অর্থাৎ ঘাটতি আসে ২৭ হাজার ৩০২ লিটার।

গত ১৬ অক্টোবর কমিটির জমা দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, ফতুল্লা ডিপোর ২২ নম্বর ট্যাংকে নতুন ও পুরোনো চার্টে পরিমাণগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আর ২৩ নম্বর ট্যাংকে চার্ট ঠিক থাকলেও বাস্তবে ট্যাংকের সক্ষমতা বেশি পাওয়া যায়। ২৩ নম্বর ট্যাংকটি নতুন করায় আগের কোনো চার্টের সঙ্গে তুলনা করা যায়নি। সাধারণত ট্যাংক খালি থাকা অবস্থায় সক্ষমতা যাচাই করা হয়। ট্যাংকে তেলভর্তি থাকায় তা সম্ভব হয়নি। তাই স্ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে যাচাই করা হয়েছে। এতে ২২ নম্বর ট্যাংকে সর্বোচ্চ তেল ধারণ সক্ষমতা ৭০ লাখ ৩৮ হাজার ৪০৪ লিটার। আগে সক্ষমতা দেখানো হয় ৬৯ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ লিটার। এর মানে এই ট্যাংকে নতুন করে যাচাইয়ের পর সক্ষমতা বেড়েছে ৬৬ হাজার ১৮৭ লিটার। আর ২৩ নম্বর ট্যাংকে নতুন করে সক্ষমতা পাওয়া গেছে ৫০ লাখ ৫৯ হাজার ২৮২ লিটার। আগে ছিল ৫০ লাখ ৪৭ হাজার ২৭৭ লিটার। এতে সক্ষমতা বেড়েছে ১১ হাজার ৩০৫ লিটার।

এর বাইরে যমুনার তেল চুরিসহ অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা হয়নি।

জাহাজ থেকে পেট্রলপাম্প পর্যন্ত তেল চুরি হয়, যা সর্বজনবিদিত। চুরি রোধে পাইপলাইন করা হলো। তারপরও তেল গায়েব হয় কী করে? ট্যাংকের সক্ষমতা কমানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি হলো না কেন? আগে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় চুরি হয়েছে। কিন্তু এখন কেন হচ্ছে? তেল চুরি রোধে স্বার্থ-সংঘাতমুক্ত নাগরিকদের দিয়ে বা আদালতের মাধ্যমে তদন্ত কমিটি করতে হবে।
এম শামসুল আলম, ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা

জ্বালানি তেল চুরি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত মাসে (নভেম্বর) বিপিসির ঢাকা কার্যালয়ে একটি সভা করেন জ্বালানিসচিব। সভার কার্যবিবরণী বলছে, বিপিসি চেয়ারম্যান বলেছেন, জ্বালানি তেল সরবরাহে পাইপলাইন চালু হওয়ায় একটি অসাধু চক্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের দৌরাত্ম্য বন্ধে বিপিসির তেল বিপণন কোম্পানিগুলো নিয়মিত নজরদারিসহ দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে। এ ছাড়া একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয় হয়। কমিটি কারিগরি, অপারেশন ও লজিস্টিক বিষয় পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেবে। পাশাপাশি প্রচারিত সংবাদসহ জ্বালানি তেল চুরির বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে তারা সুপারিশ দেবে।

আরও পড়ুন

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজ থেকে পেট্রলপাম্প পর্যন্ত তেল চুরি হয়, যা সর্বজনবিদিত। চুরি রোধে পাইপলাইন করা হলো। তারপরও তেল গায়েব হয় কী করে? ট্যাংকের সক্ষমতা কমানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি হলো না কেন? আগে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় চুরি হয়েছে। কিন্তু এখন কেন হচ্ছে? তেল চুরি রোধে স্বার্থ-সংঘাতমুক্ত নাগরিকদের দিয়ে বা আদালতের মাধ্যমে তদন্ত কমিটি করতে হবে।