সন্দ্বীপ ট্র্যাজেডির ৬ বছর আজ, এখনো নিরাপদ হয়নি যাতায়াতব্যবস্থা

সন্দ্বীপ উপকূল থেকে কিছুটা দূরে নোঙর করে যাত্রীবাহী জাহাজ। সেখান থেকে ‘লালবোট’ দিয়ে উপকূলে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। সম্প্রতি কুমিরা নৌ–ঘাট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সন্দ্বীপ ট্র্যাজেডির ছয় বছর আজ ২ এপ্রিল। ২০১৭ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে যাত্রী নিয়ে সন্দ্বীপ উপকূলে পৌঁছানোর পর সি-ট্রাক থেকে যাত্রী নামানোর সময় ‘লালবোট’ (উপকূলে যাত্রী নামানোর ছোট নৌকা) ডুবে ১৮ জন প্রাণ হারান। ওই দুর্ঘটনার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সাগরবেষ্টিত উপজেলাটির যাতায়াতব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে সি-ট্রাকের পরিবর্তে যাত্রীবাহী জাহাজ দিলেও এখনো উপকূলে যাত্রী ওঠানামা হচ্ছে অনিরাপদ ‘লালবোট’ দিয়ে। বন্ধ হয়নি অনিরাপদ স্পিডবোট ও কাঠের তৈরি ট্রলারে যাত্রী পারাপার। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

সর্বশেষ গত বছরের ১৯ আগস্ট কাঠের তৈরি ট্রলার থেকে নামতে গিয়ে সাগরে পড়ে এক ব্যক্তি মারা যান। এর আগে ওই বছরের ২০ এপ্রিল স্পিডবোট ডুবে একই পরিবারের তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়। গেল ছয় বছরে নৌ দুর্ঘটনায় সন্দ্বীপের ২৩ জন ব্যক্তি মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে।

আরও পড়ুন

সন্দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন, দেশে উন্নয়নের ৫০ বছরেও সন্দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যাতায়াতব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো পুরোনো ব্যবস্থায় অনিরাপদভাবে তাঁদের যাতায়াত করতে হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেও কোনো লাভ হয়নি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর পর সন্দ্বীপের সঙ্গে সীতাকুণ্ডের ফেরি চলাচলের একটি প্রস্তাবনা আসে। এরপর একাধিকবার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফেরি চলাচলের সম্ভাব্য রুট ঠিক করতে সন্দ্বীপের বিভিন্ন ঘাট পরিদর্শন করেন। এতে সন্দ্বীপের বাসিন্দাদের নিরাপদ নৌ যাতায়াতের আশা বাড়িয়ে দেয়। তবে এ নিয়ে কোনো প্রকল্প তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি।

আরও পড়ুন

বিআইডব্লিউটিএর ভাষ্য, সম্ভাব্য ফেরিঘাটের উভয় পাশে যান চলাচলের সড়ক নেই। বিকল্প ঘাটের চ্যানেল ড্রেজিং করে ফেরি চালানো যায় কি না, সেটা তারা বিবেচনা করছে। সংস্থাটির ড্রেজিং বিভাগ বলছে, কালবৈশাখীর সময় শুরু হওয়ায় বর্ষা মৌসুমের আগে ড্রেজিংয়ের কাজ করা যাচ্ছে না। বর্ষার পর ড্রেজিংয়ের কাজ করা হবে।

সন্দ্বীপে নিরাপদ নৌ যাতায়াতের জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছেন খাদেমুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সন্দ্বীপের সঙ্গে সীতাকুণ্ডে ফেরি চলাচলের জন্য এখনো প্রকল্প তৈরি হয়নি শুনে তাঁরা হতাশ। এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফেরি চলাচলে তাঁরা আশাবাদী হয়েছিলেন। কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটে যাত্রীবাহী জাহাজ দিলেও জাহাজে ওঠানামার ব্যবস্থা এখনো অনিরাপদ। জাহাজে ওঠানামার জন্য তাঁরা সি-ট্রাকের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে আসছেন।

আরও পড়ুন

বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক নয়নশীল প্রথম আলোকে বলেন, ঘাটের কর্তৃত্ব নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে জেলা পরিষদের একটি মামলা আছে। আগামী মাসে উচ্চ আদালতে মামলাটির শুনানি হওয়ার কথা আছে। ওই শুনানি শেষে কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট তাঁদের মালিকানায় এলে যাতায়াত নিরাপদ করার সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেন। এখন জেলা পরিষদ সেখানে নৌ যাতায়াতব্যবস্থা পরিচালনা করছে।

বিআইডব্লিউটিএর এই কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, জেলা পরিষদ অবৈধ ও অনিরাপদ নৌযান দিয়ে যাত্রী পারাপার করছে। তাঁরা আগে অনিরাপদ নৌযানে যাত্রী পারাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একাধিকবার জেলা পরিষদ ও ঘাটের ইজারাদারকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তাঁরা কানে তুলছেন না। তিনি বলেন, সন্দ্বীপ চ্যানেল ১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত উত্তাল থাকে। এ সময় অবৈধ নৌযানে যাত্রী পারাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে জেলা পরিষদকে চিঠি দিয়েছেন তাঁরা।

ফেরি চলাচলের সর্বশেষ অবস্থা

সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সীতাকুণ্ডের সঙ্গে সন্দ্বীপের ফেরি চলাচলের জন্য একাধিক ঘাট পরিদর্শন করেন বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা। তাঁরা সন্দ্বীপের গাছুয়া ও সীতাকুণ্ডের ডোমখালী ঘাট নির্ধারণ করেন। কিন্তু গাছুয়া ঘাটের সঙ্গে ভূখণ্ডে যাতায়াতের পর্যাপ্ত সড়ক না থাকায় সেখানে সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দেয় বিআইডব্লিউটিসি। স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলী এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সড়কটি নির্মাণে আলাদা বাজেট তৈরি করেন। পরে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সড়কটির নির্মাণকাজ চলছে।

উপজেলা প্রকৌশলী মো. রাশেদুন্নবী বলেন, তিনি একটি বাজেট তৈরি করেছিলেন। তবে তাঁর দপ্তরের মাধ্যমে সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে না। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. ইসমাইল প্রথম আলোকে বলেন, গাছুয়া অংশে সড়ক নির্মাণের জন্য আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মার্চের শেষে কাজ শুরু হয়েছে। এপ্রিলের মধ্যে কাজ শেষ করবেন। দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি ২০ ফুট চওড়া।

সীতাকুণ্ড–সন্দ্বীপে ফেরি চলাচলের জন্য সন্দ্বীপের গাছুয়া ঘাটে সড়ক নির্মাণকাজ চলছে। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

‘মিরসরাই-সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া, টেকনাফের (সাবরাং ও জালিয়াদ্বীপ) জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, সন্দ্বীপের গাছুয়া-ডোমখালী ঘাটে ফেরি চলাচলে কোনো প্রকল্প তৈরি হয়নি। তাঁরা আপাতত ড্রেজিং করে কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটে ফেরি চলাচল করা যায় কি না, সেটি বিবেচনা করছেন।

বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউর রশিদ বলেন, গত বছরের নভেম্বরে সন্দ্বীপ উপকূলে খাল ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয় কিন্তু ড্রেজিংয়ের কয়েক দিনের মাথায় খাল আবার ভরে যায়। কালবৈশাখীর সময় ড্রেজারসহ যন্ত্রপাতি সন্দ্বীপ উপকূলে রাখা অনিরাপদ ভেবে মার্চের শুরুতে ড্রেজারটি উঠিয়ে আনা হয়েছে। জুলাইয়ের পর সন্দ্বীপ চ্যানেল স্থির হলে খননকাজ চালানো হবে।

আরও পড়ুন

ছয় বছরেও ক্ষতিপূরণ পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা

সন্দ্বীপে নৌ দুর্ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হলেও ওই ঘটনায় প্রাণ হারানো ১৮ জনের স্বজনেরা এখনো পুরো ক্ষতিপূরণ পাননি। ওই ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন মুছাপুর সেনেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ ওসমান গণি। তাঁর দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে। নিহত ওসমান গণির ভাই সুফিয়ান মানিক বলেন, দুর্ঘটনার পর লাশ দাফনের জন্য ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিল সরকার। এরপর ক্ষতিপূরণ বাবদ তাঁরা আর কোনো টাকাপয়সা পাননি। তাঁরা জানতে পেরেছেন, উচ্চ আদালত থেকে তাঁদের ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে।