‘পদ্মারে আমার মারে কেমনে নিয়া গেলিরে...আমার বাবারে তুই ফিরায় দে। আল্লাহ তুমি গায়েবিভাবে আমার মারে আইনা দেও।’
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার হাসাইলচর এলাকায় পদ্মার শাখা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এসব বলে আহাজারি করছিলেন পাঁচগাঁও ইউনিয়নের মান্দ্রা এলাকার বাসিন্দা নজরুল ব্যাপারী। ট্রলারডুবিতে তিনি একমাত্র মেয়ে শিফাকে হারিয়েছেন। একই দুর্ঘটনায় এখনো নিখোঁজ আছেন শিফার খালাতো ভাই মাহফুজুর রহমান।
নজরুল ব্যাপারী বলেন, ‘গতকাল শিফা, ওর খালাতো ভাই মাহফুজ, মাহফুজের স্ত্রীসহ ৫ জন হাসাইলচরে বেড়াতে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় ওরা সবাই ট্রলারে করে নদী পার হচ্ছিল। বাল্কহেড সব শেষ করে দিল। কত মানুষ জীবিত আসলো, আমার মেয়েটা লাশ হয়ে আসলো। মাহফুজকে তো খুঁইজাই পাইতাছি না।’
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যায় হাসাইলচর থেকে ৪০-৫০ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলারটি হাসাইল ঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়। তখন দক্ষিণ দশআনি নামের একটি বাল্কহেড চাঁদপুর থেকে বালু আনতে ওই নৌপথ দিয়ে পদ্মা নদীর দিকে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে বাল্কহেডটি ট্রলারের ওপর উঠে যায়। এ ঘটনার পর সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন দুজনের লাশ উদ্ধার করে। এখনো দুজন নিখোঁজ আছেন। তাঁদের সন্ধানে আজ ভোর থেকে নদীতে অভিযান চালাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিস, বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পুলিশের সদস্যরা। এর মধ্যে আজ বেলা পৌনে দুইটার দিকে ডুবে যাওয়া ট্রলারটি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এতে কারও মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
নিহত দুজন হলো নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার কাশিপুর এলাকার মো. ফারুকের মেয়ে ফাইজা আক্তার (৬) এবং মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নজরুল ব্যাপারীর মেয়ে শিফা (১৫)। আর আজ বেলা তিনটা পর্যন্ত নিখোঁজ আছেন সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. হারুন অর রশিদ খান (৫০) ও রাজধানীর ধানমন্ডির শংকর এলাকার বাসিন্দা ও শিফার খালাতো ভাই মাহফুজুর রহমান (৩৫)।
গতকাল রাত থেকে আজ রোববার দুপুর পর্যন্ত স্বজনেরা নিখোঁজদের জন্য নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছিলেন। নিহত ও নিখোঁজদের কথা মনে করতেই বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন তাঁরা।
নিখোঁজ মাহফুজুর রহমানের মা–বাবা দুজনই মারা গেছেন জানিয়ে নজরুল ব্যাপারী বলেন, ‘মাহফুজের মা মারা যাওয়ার আগে ওদের চার ভাইকে আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছে। ওর মা আমাকে দেখে রাখতে বলেছিল। মাহফুজরা ঢাকায় ছিল। ওদের অফিস বন্ধ থাকায় আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে বলেছিলাম। আমাদের বাড়িতে এসে পদ্মায় ডুবল। আমি এখন কী জবাব দেব!’
নিখোঁজদের আরেকজন মালখানগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হারুন অর রশিদ। তিনি হাসাইলচরের বিস্তীর্ণ জমিতে এবার আলুর আবাদ করেছেন। বৃষ্টিতে পচে যাওয়া আলু তোলা, নতুন করে জমিতে আলুর আবাদ করতে কয়েক দিন ধরে হাসাইলচরে অবস্থান করছিলেন তিনি। শনিবার সন্ধ্যায় ট্রলারে করে বাড়িতে ফিরছিলেন।
হারুন অর রশিদের চাচাতো ভাই মনসুর আহমেদ বলেন, ‘আমার ভাই আমাদের খুব ভালোবাসতেন। কখনো চাচাতো ভাই মনে করতেন না। বাল্কহেডের কারণে আমার ভাই আজ নিখোঁজ। গতকাল রাত থেকে ভাইকে নদীর সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোথাও পাচ্ছি না। ভাইকে জীবিত না হোক মৃত শরীরটাও যদি পাই, আমরা আমাদের মনটাকে বুঝাতে পারব।’
ডুবে যাওয়া ট্রলারটি উদ্ধার
বাল্কহেডের ধাক্কায় ডুবে যাওয়া যাত্রীবাহী ট্রলারটি উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। আজ বেলা পৌনে দুইটার দিকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ট্রলারটি নদীর তলদেশ থেকে উদ্ধার করা হয়।
বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক ও উদ্ধার অভিযান প্রত্যয়ের কমান্ডার ওবায়দুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী ক্রেন বোট ক্ষণিকা-১ বেলা পৌনে একটার দিকে দুর্ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। তখন থেকে ট্রলার উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়। এক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় এবং স্থানীয়দের সহযোগিতায় ট্রলারটি পৌনে দুইটার দিকের নদীর তলদেশ থেকে টেনে তোলা হয়। এ সময় নিখোঁজ কারও সন্ধান মেলেনি ট্রলারে। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলার থেকে একটি মোটরসাইকেল, মুঠোফোন, দা ও বঁটি উদ্ধার করা হয়েছে।
চর আবদুল্লাহ নৌ পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক মো. হাসনাত জামান বলেন, অবৈধ বাল্কহেড চলাচলের বিষয়ে তাঁরা নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করছেন। ঘটনার সঙ্গে বাল্কহেডের মালিক ও চালক—যাঁরা জড়িত, তাঁদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। দোষী ব্যক্তিদের আটক করতে পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে।