রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সামাদের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন পুঠিয়া উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। গতকাল বুধবার উপজেলা চত্বরে ওই নেতার বিরুদ্ধে মানববন্ধনও করেছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্যের অনুসারী নেতারা বিদ্যালয়টির কমিটি নিয়ে টানাটানি শুরু করেছেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বর্তমান সংসদ সদস্যের মত নিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠন করার প্রক্রিয়া করছেন। আর সাবেক সংসদ সদস্যের অনুসারী আওয়ামী লীগের নেতারা চাইছেন তাঁদের মতো করে কমিটি গঠন করতে।
এমন বিভিন্ন ইস্যুতে পুঠিয়ায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের বিরোধ প্রকট হয়ে উঠছে। এক পক্ষে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ। অন্য পক্ষে আছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মনসুর রহমান। তবে আবদুল ওয়াদুদ বলছেন, তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকায় বর্তমান সংসদ সদস্যসহ সবাই তাঁর অনুসারী। আলাদা করে তাঁর অনুসারী নেই।
আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক চিকিৎসক মনসুর রহমান। এর আগের দুই মেয়াদে এই আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন আবদুল ওয়াদুদ। নির্বাচনের পরে ‘মনোনয়নবঞ্চিত’ আবদুল ওয়াদুদ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এর পর থেকে এই নির্বাচনী এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়।
দলের একটি সূত্র বলছে, প্রায় সাত বছর পর গত বছরের মার্চ মাসে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। সেখানে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনেই বর্তমান সংসদ সদস্যের অনুসারীরা দায়িত্ব পান। এরপর তিনটি ইউনিয়ন কমিটির নেতৃত্বও সংসদ সদস্যের অনুসারীদের হাতে যাওয়ার পর অন্য ইউনিয়নের কমিটি আর করা হয়নি। এমনকি জেলার সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদের নিজের ইউনিয়ন বানেশ্বরেও কমিটি গঠন করা হয়নি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার রহিম বলেন, অন্য যে কারণই থাক, তাঁদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে কমিটিতে একের পর এক সংসদ সদস্যের অনুসারীরা আসার কারণেই বাকি ইউনিয়নে কমিটি করা বন্ধ রাখা হয়েছে।
রাজশাহীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের যাতায়াতের জন্য টাকা তোলা নিয়ে গত ২৫ জানুয়ারি পুঠিয়ায় দলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে গুরুতর আহত একজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এসে দুই পক্ষের চারজনকে আটক করেছে। বিকেলে অবশ্য তাঁদের আবার ছেড়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাটটি ইজারা দেওয়া হয়েছে। হাটের ইজারাদারের অভিযোগ, সরকারদলীয় কোনো অনুষ্ঠান হলেই ইজারাদারের কাছ থেকে খরচ নেওয়া হয়। রাজশাহীতে ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় যাওয়ার খরচের বিষয় নিয়ে ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বানেশ্বর বণিক সমিতির কার্যালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সংসদ সদস্য মনসুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ ও জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ওবায়দুর রহমানের জন্য হাট কমিটির কাছ থেকে আলাদা খরচ দাবি করা হয়।
সভায় সংসদ সদস্য মনসুর রহমানের পক্ষে জেলা যুবলীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক সেলিম শেখ এবং সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদের পক্ষে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন। তবে হাট কমিটি পৃথক তিন জায়গায় খরচ দিতে আপত্তি করে। শেষ পর্যন্ত তারা কাউকেই খরচ দিতে রাজি হয়নি। একপর্যায়ে স্থানীয় খুঁটিপাড়া গ্রামের আওয়ামী লীগের সমর্থক হাবিবুর রহমান এই খরচ নেওয়ার বিষয় নিয়ে আবুল কালাম আজাদের কথার প্রতিবাদ জানান। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। পরে হাট কমিটির লোকজন তা মীমাংসা করে দেন। তারপরও এ ঘটনার জেরে পরের দিন দুপুরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
জানতে চাইলে তখন সংসদ সদস্য মনসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁর লোকজনকে জনসভায় নেওয়ার জন্য তিনি কাউকে যাতায়াতভাড়া দিতে বলেননি। এ রকম নির্দেশনা চার বছর আগেও কাউকে দেননি। এখনো দেননি। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ বলেছিলেন, তিনি ঘটনাটি ভাসা-ভাসা শুনেছেন।
গতকাল বুধবারের মানববন্ধনে সৈয়দ করম আলী শাহ্ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কোরবান আলী বলেন, করোনাকালে তাঁর বিদ্যালয়ে একটি অ্যাডহক কমিটি করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন থেকে সেই কমিটি বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তাঁরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জন্য কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। গত সোমবার হঠাৎ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ মোল্লাসহ স্থানীয় ১০ থেকে ১৫ জন ব্যক্তি বিদ্যালয়ে আসেন। একটি লিখিত কাগজ তাঁর সামনে দিয়ে এতে সই করার জন্য জোরাজুরি করেন। তিনি সই দিতে না চাইলে আবদুস সামাদ মোল্লা তাঁর কলার ধরে টানাটানি ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। তাঁকে মারার জন্য তাঁরা তেড়ে এলে ভয়ে বিদ্যালয়ের টয়লেটে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই তিনি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন দিলে পুঠিয়া থানার পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে। সেদিনই তিনি থানায় আওয়ামী লীগের ওই নেতার বিরুদ্ধে জিডি করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবদুস সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই প্রধান শিক্ষককের লাঞ্ছিত করার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তুচ্ছ বিষয়কে এভাবে স্থানীয় সংসদ সদস্য বড় করছেন। তিনি বলেন, ২০১৭ সাল থেকে সংসদ সদস্যের কথামতো ওই প্রধান শিক্ষক অ্যাডহক কমিটি দিয়ে বিদ্যালয় চালাচ্ছেন। এবার গোপনে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার প্রক্রিয়া করছেন, কিন্তু তফসিল ঘোষণা করা, প্রকাশ্যে ভোটার তালিকা টাঙানো কিছুই করা হয়নি। স্থানীয় অভিভাবকদের অনুরোধে তিনি ওই বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নির্বাচনসংক্রান্ত কাগজপত্র দিতে বলছিলেন। প্রধান শিক্ষক সেগুলো না দিয়ে টয়লেটে গিয়ে ৯৯৯–এ ফোন করে পুলিশ ডেকে আনেন।
এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য মনসুর রহমান বলেন, শিক্ষককে মারার ঘটনা সঠিক। তিনি পরের দিনই প্রতিবাদ সভা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন স্থানীয় নেতারা এলাকায় না থাকায় প্রতিবাদ সভা করা হয়নি। গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই নেতার বিচার দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে। প্রতিবাদ সভাও করবেন।
এসবের কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ। তিনি ঢাকায় আছেন উল্লেখ করে বলেন, কাউকে আলাদা করে তাঁর অনুসারী বলা যাবে না। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলের সবাই তাঁর অনুসারী। এমনকি সংসদ সদস্য মনসুর রহমানও তাঁর অনুসারী। কারণ, তিনি জেলা আওয়ামী লীগের একজন সম্মানিত সদস্য।