রাবি ছাত্রী রিক্তা ‘হত্যা’র বিচার দাবি শিক্ষক-সহপাঠীদের
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রিক্তা আক্তারকে তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ ইসতিয়াক হত্যা করেছেন বলে দাবি করেছেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাঁরা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনসংলগ্ন প্যারিস রোডে এই মানববন্ধন করা হয়।
এর আগে গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী নগরের ধরমপুর পূর্বপাড়া এলাকার ভাড়া বাসা থেকে রিক্তা আক্তারের লাশ উদ্ধার করা হয়। রিক্তার বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জোতপাড়া গ্রামে। তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ ইসতিয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে। আড়াই বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়। দুজনে নগরের ধরমপুর পূর্বপাড়া এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বাবা লিয়াকত জোয়ারদার একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় আবদুল্লাহ ইসতিয়াক গ্রেপ্তার আছেন।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান হাবীবের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য দেন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল হান্নান, অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দীকা, অধ্যাপক আবদুল আলিম, অধ্যাপক সাঈদা আঞ্জু, অধ্যাপক মো. সাহাল উদ্দীন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আকতার বানু, রিক্তার সহপাঠী রাকিবা আক্তার, কায়েস মাহমুদ প্রমুখ।
কায়েস মাহমুদ বলেন, সহপাঠী হিসেবে দুই বছর রিক্তা তাঁদের সঙ্গে পড়ালেখা করেছেন। কিন্তু তাঁর স্বামী তাঁকে কখনো তাঁদের সঙ্গে মিশতে দেননি। রিক্তা স্বামীর দ্বারা নানা সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁর স্বামী বিয়ের পর এক লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেছিলেন। টাকা দিতে না পারায় তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। কোরবানির ঈদের চার দিন আগে রিক্তা হঠাৎ তাঁর দুলাভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে এই বিষয়গুলো জানান। মামলার আলামত ও অন্যান্য বিষয় দেখে এটাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলা যায়। তাঁরা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত বিচার দাবি জানান। পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ছাত্রত্ব বাতিল করে রিক্তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান।
অধ্যাপক আবদুল আলিম বলেন, তিনি রিক্তাকে পড়িয়েছেন। তাঁর শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটা সুস্পষ্ট হত্যাকাণ্ড। কিন্তু বিভিন্নভাবে এটা আত্মহত্যা হিসেবে প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর চরিত্র নিয়ে কথা হয়েছে। ভিকটিম ব্লেমিং সব সময়ই এই সমাজে হয়ে থাকে। নারীর প্রতি সহিংসতা, অবমাননা লক্ষ করা যাচ্ছে। আজকে যেখানে একজন শিক্ষার্থী সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবেন, কিন্তু তিনি নিজ কক্ষে তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করছেন। শ্বাসরোধে হত্যার পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে তাঁকে জানালার গ্রিলের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আবদুল আলিম আরও বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আনার জন্য মা–বাবাকে ব্যাপক কষ্ট করতে হয়। শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, অবশ্যই ভুক্তভোগী পরিবারকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা সবাই ভুক্তভোগী। সবার মানসিক কষ্ট হয়েছে। এই বিষয়গুলোও বিচারকাজে থাকা ব্যক্তিদের বিবেচনায় আনা দরকার। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। আমরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে চাই না।’
অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দীকা বলেন, শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সমস্যা হলে তাঁরা অবশ্যই যেন শিক্ষকদের কাছে আসেন। এই শিক্ষার্থী যদি আগে আসতেন, তাঁরা শুনতেন। অনেক সমস্যা নিয়ে বিভাগের শিক্ষার্থী এসেছেন। তাঁরা কিন্তু তাঁদের ফেলে চলে যাননি। কিন্তু রিক্তা কোনো দিন তাঁদের কাছে আসেননি। এ ধরনের সমস্যায় পড়লে ছাত্রী হন বা ছাত্র হন, অবশ্যই শিক্ষকদের বলবেন। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা মনে করেন, কার কাছে যাবেন, কাজেই এ ধরনের কোনো স্বীকৃত পদ থাকলে সেখানে শিক্ষার্থীরা বলতে পারবেন। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অনুরোধ জানান তিনি।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল হান্নান বলেন, তাঁরা জেনেছেন, রিক্তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু শুরুতে এটাকে আত্মহত্যা বলা হচ্ছিল। তাঁরা চান, দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে বিচার নিশ্চিত করা হোক। তদন্তে ধীরগতি হলেই সুষ্ঠু বিচারে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান বলেন, রিক্তার মৃত্যুতে তাঁরা শোকাহত। তাঁদের হৃদয় রক্তাক্ত। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যাঁরা জড়িত, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাঁদের দ্রুত সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া বলেন, ‘নারীরা আজ নিজের ঘরেও নিরাপদ নন। এ দেশে নিজের ঘরে নারীদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে। এটি বাড়ছে, কারণ এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক যে এ নিয়ে আগে মানববন্ধন না করে ঘটনার পরে দাঁড়াতে হচ্ছে। একজন শিক্ষক, মা ও নারী হিসেবে জানি না, সমাজের কোথায় তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন। এগুলো উপড়ে ফেলার শক্তি আমাদের নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি, এটাকে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড হিসেবে দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করা হোক।’
নগরের মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার আলী তুহিন বলেন, তাঁরা এ ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড ধরে তদন্ত করছেন। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন। আজ তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হবে।