নৌকাডুবিতে নিহত সুবর্ণার প্রতিবন্ধী মেয়ে ইকরার ধূসর ঈদ
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মেঘনা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় পর্যটকবাহী নৌকাডুবিতে যে নয়জনের মৃত্যু হয়, পারলারকর্মী সুবর্ণা বেগম (২০) তাঁদের একজন। ছয় মাস আগে মাদকাসক্ত স্বামীর সংসার ছেড়ে একমাত্র মেয়ে ইকরা মণিকে সঙ্গে নিয়ে সুবর্ণা আশ্রয় নিয়েছিলেন বাবার বাড়িতে। চার বছর বয়সী ইকরা জন্ম থেকেই শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। মায়ের মৃত্যুর পর ইকরার ঠিকানা হয়েছে নানাবাড়ি। রাত পোহালেই ঈদ। ইকরার জন্য এবার ঈদে কোনো জামা কেনা হয়নি।
অশ্রুসজল নানি নাজমা বেগম বলেন, ‘আমরার কোনো ঈদ নাই। ইকরারও নাই। আমি মেয়ে হারাইছি। ইকরা হারাইছে মা। প্রতিবছর ঈদে ঘুম থেকে উঠেই মেয়েকে নতুন জামা পরাত সুবর্ণা। এবার নতুন জামা পরানোর মানুষ নাই...’ এই কথা বলে চোখ মোছেন নাজমা।
সুবর্ণার বাবার নাম স্বপন মিয়া। স্বপন পেশায় ভৈরবের একটি রড–সিমেন্ট দোকানের শ্রমিক। বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার লঙ্কাকান্দা গ্রামে। তবে দুই যুগ ধরে তিনি ভৈরবে থাকেন। স্বপনের পাঁচ মেয়ে। সুবর্ণা সবার বড়। ছয় বছর আগে ভৈরব উপজেলার শ্রীনগর গ্রামের সুমন মিয়ার সঙ্গে সুবর্ণার বিয়ে হয়। ইকরা তাঁদের একমাত্র সন্তান।
গতকাল বুধবার দুপুরে ভৈরব পৌর শহরের বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া কমলপুর এলাকার স্বপন মিয়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ইকরা ঘুমাচ্ছে। পাশে বসে ইকরার ছোট খালা তাপসী (১১)। তাপসী জানায়, ইকরা দাঁড়াতে পারে না। বসে থাকতে পারে না। কথাও বলতে পারে না। তার সব অনুভূতি প্রকাশ পায় চোখ ও মুখ দিয়ে। দুর্ঘটনার পর থেকে চোখ এদিক-ওদিক করে মাকে খোঁজে। এবারের ঈদ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। নতুন জামা কেনা নিয়েও কোনো আগ্রহ নেই।
স্বপন মিয়ার পাঁচ মেয়ের মধ্যে তিনজনের বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে অবিবাহিত দুই মেয়ে তাপসী ও পুতুলই (১৪) ইকরাকে দেখাশোনা করে। পরিবারের সদস্যরা জানালেন, সুমন মাদকে আসক্ত হওয়ায় স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন না। মেয়ে ও নিজের খরচ জোগাতে কিছুদিন আগে পারলারে চাকরি নেন সুবর্ণা। দুর্ঘটনার দিন বান্ধবীরা মিলে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ইকরাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা স্বপন নিয়ে যেতে দেননি।
ইকরার জন্য সরকারি প্রতিবন্ধী কার্ড পেলে ভালো হতো বলে জানান তার নানা স্বপন মিয়া।
স্বপন মিয়া বলেন, অভাবের সংসার তাঁর। অভাব থাকলেও মেয়েদের আদরের কমতি ছিল না কখনো। ঈদে সবার আবদার রক্ষা করার চেষ্টা করতেন তিনি। সুবর্ণা নেই, এবার কারও কোনো আবদার নেই। আগের রঙিন ঈদ এবার যেন ধূসর। স্বপন মিয়া দুঃখ করে বলেন, সুবর্ণার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর জামাতা সুমন কেবল দেখতে এসেছিলেন। এরপর একটি দিনের জন্য মেয়ের খবর নেওয়ার চেষ্টা করেননি। ইকরার জন্য সরকারি প্রতিবন্ধী কার্ড পেলে ভালো হতো বলে জানান স্বপন।
স্থানীয় লোকজন জানান, মেঘনা নদীতে পাশাপাশি দুটি রেল ও একটি সড়ক সেতু রয়েছে। তিনটি সেতুকে ঘিরে ভৈরব প্রান্তে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। ঘাটে বেশ কয়েকটি পর্যটকবাহী নৌকা রয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ নৌকার মাধ্যমে মেঘনা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করেন। বিশেষ করে শুক্রবার পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যায়। গত ২২ মার্চ দুর্ঘটনার দিনটি ছিল শুক্রবার। ওই দিন বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে ১৫ থেকে ১৮ জন আরোহী নিয়ে একটি নৌকা ঘাট ছেড়ে যায়। তীরে ফিরে আসার সময় সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌকাটি ডুবে যায়।
অনেকে বেঁচে ফিরতে পারলেও মারা যান নয়জন। দুর্ঘটনার কিছু সময় পর সুবর্ণার লাশ উদ্ধার করা হয়। নয়জনের মধ্যে একই পরিবারের ছিলেন চারজন। তাঁরা হলেন ভৈরব হাইওয়ে থানার কনস্টেবল সোহেল রানা, তাঁর স্ত্রী মৌসুমী বেগম (২৬), তাঁদের সাত বছর বয়সী মেয়ে ইভা বেগম ও চার বছর বয়সী ছেলে রাইসুল ইসলাম। অন্যরা হলেন কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার ইলেকট্রনিক ব্যবসায়ী বেলন চন্দ্র দে, তাঁর শ্যালকের স্ত্রী রুপা দে, সম্বন্ধীর মেয়ে সুজিতা দে আরাধ্যা (১১) এবং নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দরিগাঁও গ্রামের কলেজপড়ুয়া আনিকা বেগম।
এই ঘটনায় বাল্কহেডের সুকানি ও ইঞ্জিনচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।