আরও দুজনের লাশ উদ্ধার, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১২

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় বুধবার সকালে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে।প্রথম আলো

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় ট্রলারডুবির ঘটনার দুদিন পর আরও দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আজ শুক্রবার দুপুরে ধরমপাশা থানা-পুলিশ গুমাই নদের মোহনা হলদী নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় লাশ দুটি উদ্ধার করে। এ নিয়ে এই নৌ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১২ জনে দাঁড়াল।

উদ্ধার ব্যক্তিরা হলেন রতন মিয়া (৩৮) ও শিশু মনিরা আক্তার (৫)। রতন সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার কামাউড়া এলাকার বাসিন্দা। আর মনিরা একই উপজেলার ইনাতনগর এলাকার আব্দুল ওয়াহাবের মেয়ে। ডুবে যাওয়া ট্রলারটিতে আব্দুল ওয়াহাবের পুরো পরিবার ছিল। ওই দুর্ঘটনায় আব্দুল ওয়াহাব বেঁচে গেলেও ওই দিনই তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নাহার (৩২) ও দুই বছর বয়সী ছেলে ইয়াসিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আজ উদ্ধার হলো পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মনিরার লাশ।

এর আগে স্ত্রী-ছেলের লাশ গ্রহণ করে আব্দুল ওয়াহাব কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার এক ছেলে ও এক মাইয়াসহ স্ত্রীরে লইয়া বারহাট্টা উপজেলার ধোবালা গ্রামের ভায়রার বাড়িতে বেড়ানিত যাইতে চাইছিলাম। এই বেড়ানিই আমরার কাল অইল। আমি আমার পাঁচ বছর বয়সী মাইয়ারে লইয়া ছোট্টু ট্রলারডার এককোনাত আছিলাম। আরেক পাশে আছিল আমার স্ত্রী ও দুই বছরের ছেলে রাকিবুর। ট্রলারডাত হঠাৎ একটা ঝাঁকি মারল। আমার মাইয়ারে লইয়া কুনুরহমে ট্রলারের ওফুরে উইঠা বাঁচার লাইগ্যা ট্রলার থাইক্যা লাফ মারছি। এই সময় মাইয়াডা আমার গলা ছাইড়া দিলে হে তল অইয়া গ্যাছে। হেরে আর খুঁইজা পাইছি না। ট্রলারডা হানিত ডুইবা যাওয়ায় আমার স্ত্রী ও ছেলেরে খুঁইজা ফাইছি না। ফরে স্ত্রী ও ছেলের লাশ খুঁইজা পাইলেও মাইয়াডা অহনো নিখোঁজ আছে। এই শোক আমি কী করে সইবাম...।’

এ দুর্ঘটনায় মৃত ১২ জনের মধ্যে ১১ জনের বাড়িই সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বলে জানা গেল। শুধু একজনের বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার মেদনী গ্রামে।

আরও পড়ুন
নেত্রকোনার কলমাকান্দার ট্রলারডুবিতে নিহতদের স্বজনদের আহাজারি। বুধবার দুপুরে।
সংগৃহীত

সর্বশেষ দুটি লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করে কলমাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজহারুল করিম বেলা আড়াইটার দিকে প্রথম আলোকে জানান, হলদী নদীর মধ্যনগর এলাকার অংশে প্রথমে রতন মিয়া ও পরে মনিরার লাশটি ভাসমান অবস্থায় দেখতে পেয়ে স্থানীয় ব্যক্তিরা পুলিশে খবর দেন। ধরমপাশা থানা-পুলিশ লাশ দুটি উদ্ধার করে। পরে তাঁদের নাম–পরিচয় শনাক্ত হয়। রতনের পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ দুপুরেই লাশ তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর মনিরার লাশটি অল্প কিছুক্ষণ আগে উদ্ধার করা হয়েছে। পরে হয়তো সেটি পরিবারের কাছে তুলে দেওয়া হবে।

রতন মিয়ার ভাগনে মো. জুয়েল মিয়া (৩০) জানান, তাঁর মামা (রতন মিয়া) গত বুধবার সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে ঢাকায় রওনা দেন। তিনি ঢাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। বাড়ির পাশে নদীর ঘাটে ওই ট্রলারটিতে উঠে নেত্রকোনার ঠাকুরাকোনায় নেমে সেখান থেকে গাড়িতে করে ঢাকায় যেতে চেয়েছিলেন। পথিমথ্যে ট্রলারডুবিতে তিনি নিখোঁজ হন। আজ তাঁর লাশ তাঁরা হাতে পেলেন।

আরও পড়ুন

স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার মধ্যনগর এলাকা থেকে গত বুধবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে ৩০-৩৫ জন যাত্রী জন যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার নেত্রকোনার ঠাকুরাকোনার উদ্দেশে রওনা হয়। সকাল পৌনে ১০টার দিকে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার রাজনগর গ্রামের গুমাই নদে যাত্রীবাহী ট্রলারটির সামনে একটি বাল্কহেড চলছিল। এ সময় ট্রলারটি বাল্কহেডটিকে অতিক্রম করে আরও যাত্রী ওঠাতে ডান দিকে একটি ঘাটে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। ঠিক তখনই বাল্কহেডের সঙ্গে সংঘর্ষে ট্রলারটি উল্টে যায়। এতে এখন পর্যন্ত ১২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

নেত্রকোনার কলমাকান্দার ট্রলারডুবিতে নিহতদের স্বজনদের আহাজারি। বুধবার দুপুরে।
সংগৃহীত

এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে আব্দুল ওয়াহাব বাদী হয়ে কলমাকান্দা থানায় মামলা করেন। বেপরোয়া নৌচালনার দায়ে ২৮০ ধারা এবং অবহেলা দ্বারা মৃত্যু সংঘটনের দায়ে ৩০৪(ক) ধারায় ট্রলার ও বাল্কহেডের চালক-সহযোগী মিলিয়ে ছয়জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ গতকাল মামলার পাঁচজন আসামি বাল্কহেড মালিক সেলিম মিয়ার ছেলে বাপন মিয়া (৩২), চালক আবাল মিয়া (৩৫) ও সোহাগ রহমান (৩০), সহযোগী জাফর মিয়া (২৮), বাবুর্চি বাদল মিয়াকে (৩০) আটক করে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। অপর আসামি যাত্রীবাহী ট্রলারটির চালক সোহাগ মিয়া (৩৫) পলাতক আছেন।

এদিকে ঘটনার পর নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত বুধবার রাতে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। নেত্রকোনার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মাহমুদকে কমিটির প্রধান ও কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোহেল রানাকে সদস্যসচিব করা হয়। গঠিত কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন

নেত্রকোনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত ১২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। স্বজনদের জানানো নিখোঁজদের তালিকায় আর কেউ বাকি থাকল না। এরপরও কেউ বাদ থাকলে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের ডুবুরি দল এখনো উদ্ধারকাজ অব্যাহত রেখেছে।