২৯ মে ২০২৫। সকাল ৯টা। আকাশটা মেঘলা। রাজধানীর মালিবাগের বাসা থেকে গাড়িতে উঠেই ভাবলাম, সব ঠিকঠাকই হবে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধরলে ঢাকা কাস্টম হাউসে পৌঁছাতে বড়জোর ৪০ মিনিট লাগবে। ক্লাস শুরু হবে ১০টা ৩০ মিনিটে।
ইচ্ছা ছিল পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে মাথা ঠান্ডা করে ক্লাস নেব—প্রশিক্ষণার্থী পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) সামনে নিজের দক্ষতা প্রমাণের আজই সুযোগ। অথচ মাথায় তখনো বাজেনি বিপদের ঘণ্টা।
গাড়ি উঠল এক্সপ্রেসওয়েতে। হালকা বৃষ্টি শুরু। প্রথমে তো রোমান্টিক লাগল—শহর একটু ঠান্ডা হোক, এই ভালো। কিন্তু পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই দৃশ্য পাল্টে গেল। সামনে লাল ব্রেক লাইটের সমুদ্র। গাড়ি একচুলও এগোয় না। একটু পরে বুঝলাম, আজকের দিনটা আমার জন্য শুধু কঠিন নয়—ভয়ংকর হতে চলেছে।
হাতিরঝিলে পৌঁছে পুরোপুরি যেতে হলো। গাড়িচালক বলেন, স্যার, এই বৃষ্টিতে রাস্তায় কোথাও নড়াচড়া নেই। আমি বললাম, আজ আমাকে যেতেই হবে, বিকল্প নেই। মুঠোফোনে বারবার সময় দেখি। ৯টা ৩০… ৯টা ৪৫… ১০টা।
পাশের গাড়িতে এক যাত্রী মুঠোফোন কানে রাগান্বিত স্বরে কথা বলছেন। তিনি বলছিলেন, ‘না বলেছি তো। আমি জ্যামে, তোমার মিটিংয়ে যাব কীভাবে!’ আমিও যেন তার মতোই বন্দী, শুধু গন্তব্য আলাদা।
সকাল ১০টা ১৫ মিনিট। আমার নিশ্বাস গাঢ় হয়ে এসেছে। যদি সময়মতো না পৌঁছাই? প্রশিক্ষণার্থীরা বসে থাকবেন, কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা খোঁজ নেবেন—‘ইনস্ট্রাক্টর কোথায়?’ কোর্স সমন্বয়ক (কো-অর্ডিনেটর) রাগ করবেন। আমার প্রশাসনিক প্রতিবেদনে দাগ পড়বে। এই একটা ক্লাস আমার চাকরিজীবন ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে পারে।
১০টা ৪৫ মিনিট। আমি ফোন দিলাম কোর্স সমন্বয়ককে। ধরা মাত্র বললাম, ‘স্যার, জ্যামে একদম আটকে গেছি।’ আশ্চর্য হয়ে শুনলাম, তিনি নিজেও যানজটে। কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কিন্তু মাথায় একটাই প্রশ্ন, ‘আমি আদৌ পৌঁছাতে পারব তো?’
সময় তখন ১১টা। গাড়ি একটু একটু করে চলছে। হঠাৎ একটা অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে সামনে গেল। পেছনে একটা ফাঁকা গলি। চালক বলল, ‘স্যার, যদি রিস্ক (ঝুঁকি) নেই, ওই পথ ধরি?’ আমি এক মুহূর্ত ভাবলাম না, বললাম, ‘চলেন।’
গলি ভাঙাচোরা, কাদা-মাখা, কিন্তু গতির নাম গতি। ১১টা ৪৫ মিনিটে কাস্টম হাউসের ফটকে ঢুকলাম। দৌড়ে গেলাম শ্রেণিকক্ষে। প্রশিক্ষণার্থীরা তাকিয়ে, টেবিলে বোতলভর্তি পানি, ফাইল আর ডিজিটাল পর্দায় ‘স্লাইড ওপেন’।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মজা করে আমি বললাম, চলুন শুরু করি। আজকের ক্লাসের নাম ‘যানজটের ভেতর কর্তব্য’।
যদিও আমার ক্লাসের বিষয় ছিল ‘কাস্টমস আইন, ২০২৩’।
কর্তৃপক্ষ ভয়াবহ যানজটের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ায় আমি সমস্যার মুখে পড়িনি।
লেখক: এ কে এম সুলতান মাহামুদ, যুগ্ম কমিশনার, বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ)।