মহেশখালীর চরে কেন দেখা মিলছে না মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান পাখির
পরিযায়ী পাখিটির নাম চামচঠুঁটো বাটান। ইংরেজিতে ‘স্পুন-বিল্ড স্যান্ডপাইপার’। মহাবিপন্ন প্রজাতির এই পাখি পৃথিবীতে মাত্র ৪২০টির মতো টিকে আছে। মূলত রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে এই পাখি প্রজনন করে। প্রজননের পর অপেক্ষাকৃত কম শীতের আবাসে পরিযান করে। শীতকালে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এই পাখি বাংলাদেশে আসে।
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার চরে এই পাখির দেখা মেলে। তবে মানুষের আনাগোনা বাড়ায় ২০১৫ সালের পর থেকে উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপের চরে এই পাখির আর দেখা মেলেনি। তবে উপজেলার হাঁসের চর, তাজিয়াকাটা চর ও কালাদিয়া চরে চামচঠুঁটো বাটানের দেখা মিলছিল। কিন্তু গত দুই বছরে এই তিনটির মধ্যে একটি চরে মাত্র চারটি চামচঠুঁটো বাটান দেখা গেছে। বাকি দুটি চরে দেখা যায়নি।
গত দুই বছর ধরে জরিপ চালিয়ে এই পাখির ক্রমেই দেখা না যাওয়ার চিত্র তুলে এনেছে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ। হাঁসের চর, তাজিয়াকাটা চর ও কালাদিয়া চরে ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই জরিপ চালানো হয়।
২০১৬ সালে ‘স্পুন-বিল্ড স্যান্ডপাইপার কনজারভেশন প্রজেক্ট’-এর আওতায় এই তিন চরে ৩৫টি চামচঠুঁটো বাটানের দেখা মিলেছিল। কিন্তু ২০২২ থেকে ২০২৪ সালে করা জরিপে হাঁসের চর ও তাজিয়াকাটা চরে কোনো চামচঠুঁটো বাটানের দেখা মেলেনি। কালাদিয়া চরে চারটি পাখির দেখা গিয়েছিল।
২০২০ সালে কালাদিয়া চরে মাত্র একটি চামচঠুঁটো বাটান পাখির দেখা মিলেছিল। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে যখন আবার যাই, তখন আমাদের দলের একজন কালাদিয়া চরে একটি চামচঠুঁটো বাটান দেখেছিলেন। আর ২০২৪ সালে চারবার কালাদিয়া চরে গেলেও আমরা এই পাখির দেখা পাইনি।
এই জরিপের গবেষক ও পাখি বিশেষজ্ঞ ফরহাদ আহসান প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা প্রথম ধাপে জরিপের কাজ শুরু করেন ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। শেষ করেন ২০২৩ সালের মার্চে। জরিপের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। শেষ হয় ২০২৪ সালের মার্চে।
ফরহাদ আহসান বলেন, ‘এই সময়কালে হাঁসের চর, তাজিয়াকাটা চর ও কালাদিয়া চরে ২৬ প্রজাতির ৯ হাজার ৬৫৯টি উপকূলীয় পাখির দেখা যায়। কালাদিয়া চরে আমরা মাত্র চারটি চামচঠুঁটো বাটানের দেখা পাই। অন্য দুই চরে কোনো চামচঠুঁটো বাটানের দেখা পাইনি।’
চরের কাদাভূমি চামচঠুঁটো বাটানের বিচরণের প্রিয় জায়গা বলে উল্লেখ করেন ফরহাদ আহসান। তিনি বলেন, ৩৭০ হেক্টর আয়তনের কালাদিয়া চরে এখনো কিছু কাদাভূমি অক্ষত আছে। উন্নয়ন প্রকল্প বানাতে গিয়ে বাকি চরগুলোর কাদাভূমি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এ কারণেই বাকি চরে চামচঠুঁটো বাটান আর আসছে না।
পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল’-এর তথ্য অনুযায়ী, এখন পৃথিবীতে মাত্র ৪২০টির মতো চামচঠুঁটো বাটান পাখি টিকে আছে।
প্রজাতিটি মহাবিপন্ন
পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল’-এর তথ্য অনুযায়ী, এখন পৃথিবীতে মাত্র ৪২০টির মতো চামচঠুঁটো বাটান পাখি টিকে আছে। ২০০৯ সাল থেকে এই পাখির সংখ্যা ৯ শতাংশ হারে কমছে। প্রতি বছর শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা এই পাখির বেশির ভাগ আশ্রয় নেয় মিয়ানমার উপকূলে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ২০০৮ সালে এই পাখিকে ‘মহাবিপদাপন্ন প্রজাতি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ আ ন ম আমিনুর রহমান ২০২০ সাল থেকে চামচঠুঁটো বাটানের গতিবিধি নজরে রাখছেন। এই পাখির দেখা পেতে গত বছর মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপসহ হাঁসের চর, তাজিয়াকাটা চর ও কালাদিয়া চরে গিয়েছিলেন তিনি।
আ ন ম আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২০ সালে কালাদিয়া চরে মাত্র একটি চামচঠুঁটো বাটান পাখির দেখা মিলেছিল। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে যখন আবার যাই, তখন আমাদের দলের একজন কালাদিয়া চরে একটি চামচঠুঁটো বাটান দেখেছিলেন। আর ২০২৪ সালে চারবার কালাদিয়া চরে গেলেও আমরা এই পাখির দেখা পাইনি।’
অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে চরগুলোর কাদাভূমি নষ্ট হয়েছে। উজাড় করা হয়েছে প্যারাবন। এসবের প্রভাব পড়েছে পাখিসহ সার্বিক জীববৈচিত্র্যে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের থাবাসহ অন্যান্য পরিবেশ-প্রতিবেশবিরোধী কার্যক্রম থেকে চরগুলোকে রক্ষা করতে না পারলে এখানকার জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা যাবে না।
উন্নয়ন প্রকল্পের চাপসহ মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ার কারণে মহেশখালীর চর এলাকায় চামচঠুঁটো বাটান পাখি কম আসছে বলে মনে করেন আ ন ম আমিনুর রহমান।
‘অপরিকল্পিত উন্নয়নের থাবা’
জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়ুথ ফর ইকোলজি কনজারভেশন বলছে, মহেশখালী ঘিরে বিগত সরকারের আমলে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, তেল মজুতের স্থাপনা, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ কয়েকটি বৃহৎ প্রকল্প নেওয়া হয়। জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রকল্পগুলোর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আবার কয়েক দশক আগে সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবন কেটে, কাদাভূমি নষ্ট করে লবণের ঘের নির্মাণ করা হয়। পাশাপাশি দ্বীপে বেড়েছে মানববসতি। জীববৈচিত্র্যের ওপর এগুলোর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ২০০৮ সালে এই পাখিকে ‘মহাবিপদাপন্ন প্রজাতি’ হিসেবে তালিকভুক্ত করে।
ইকোট্যুরিজম পার্ক করতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অনুকূলে সোনাদিয়া দ্বীপের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার একর বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর পর থেকে নষ্ট হচ্ছিল দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য। তবে চলতি বছর এই বরাদ্দ বাতিল করে সরকার।
মহেশখালীভিত্তিক ইয়ুথ ফর ইকোলজি কনজারভেশনের দলনেতা এস এম রুবেল প্রথম আলোকে বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে চরগুলোর কাদাভূমি নষ্ট হয়েছে। উজাড় করা হয়েছে প্যারাবন। এসবের প্রভাব পড়েছে পাখিসহ সার্বিক জীববৈচিত্র্যে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের থাবাসহ অন্যান্য পরিবেশ–প্রতিবেশবিরোধী কার্যক্রম থেকে চরগুলোকে রক্ষা করতে না পারলে এখানকার জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা যাবে না।