‘ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আগে থেকেই সচেতন হতে হবে
১২ জুন ছিল ‘ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস’। ভূমিকম্প বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর পালন করা হয় দিবসটি। এর মাধ্যমে ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়ানো ও করণীয় সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়।
ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস উপলক্ষে বিএসআরএমের উদ্যোগে প্রথম আলো ডটকম আয়োজন করে ‘ভূমিকম্প: সচেতনতা ও করণীয়’ শীর্ষক তিন পর্বের বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসানের সঞ্চালনায় শেষ পর্বে আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ও ডিজাস্টার অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান এবং হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক, পিইঞ্জ।
ভূমিকম্প থেকে শহরের অবকাঠামোকে রক্ষা করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করেছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকিটা যদি আমরা কমাতে চাই, তাহলে আমাদের আরও কী করতে হবে? মোহাম্মদ আবু সাদেকের কাছে জানতে চান মুনির হাসান।
উত্তরে মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দুটো অংশ আছে। এর একটি হলো ঝুঁকি হ্রাস। আরেকটি হলো হয়ে গেলে কী করতে হবে। এ দুটোর মধ্যে ঝুঁকি হ্রাস সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার আগে যদি আমরা সেটা সম্পর্কে সচেতন হই, তাহলে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যেটা বলা হয়, আমি যদি ঝুঁকি হ্রাসে ১ টাকা খরচ করি, এটা আমাকে দুর্যোগ হয়ে যাওয়ার পর ১০ টাকার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে। এ বিষয় থেকেই সারা পৃথিবীতেই ঝুঁকি হ্রাসে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যদিও বাংলাদেশে ঝুঁকি হ্রাসের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না।
দুর্যোগ দুই রকম। একটি হলো প্রাকৃতিক, আরেকটি মানবসৃষ্ট। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আবার দুই রকম, এর মধ্যে একটিকে প্রতিরোধ করা যায়। আরেকটিকে যায় না। প্রতিরোধ করতে না পারার মধ্যে অন্যতম “ভূমিকম্প”। তাই প্রতিরোধ যখন করা যাবে না, তখন আমাদের হাতে থাকে ঝুঁকি হ্রাস। ফলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ঝুঁকি হ্রাসের ওপর। এখন আমাদের ঝুঁকি হ্রাসের টুলগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। সবচেয়ে বড় যে টুলস, সেটা হলো বিল্ডিং কোড। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী যদি আমি ভবনটি তৈরি করি, তাহলে ঝুঁকি হ্রাসের সবচেয়ে বড় টুলসটিই আমরা ব্যবহার করে ফেললাম। আমাদের দেশের সমস্যা হলো আমরা কোনো কিছুই মানি না।’
এ প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, ‘ভূমিকম্প হলে অনেক বড় একটা ক্ষতি হবে বলে আমার ধারণা। তাই ক্ষতি কীভাবে কমানো যাবে, সেটা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। তুরস্ক ও নেপাল থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। এ জন্য আমাদের শক্তিশালী জনবল গড়ে তুলতে হবে, যারা এ কাজে দক্ষ। তাহলে ভূমিকম্প হলে আমরা ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পারব এবং দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব।’
এবার সঞ্চালকের প্রশ্ন আলী আহমেদ খানের কাছে, ‘আমাদের একটা বিল্ডিং কোড আছে কিন্তু সেটা মানা হয় না কেন? আপনি তো দীর্ঘদিন ফায়ার সার্ভিসে ছিলেন। এই বিল্ডিং কোড না মানার ফলে কোনো দুর্যোগ হলে উদ্ধার করতে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় আপনাদের?’
আলী আহমেদ খান বলেন, ‘ভূমিকম্প এমন একটা দুর্যোগ, যেটা আগাম কোনো সিগন্যাল বা সংকেত দেয় না। শুধু আগাম প্রস্তুতি থাকলেই আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। তাই প্রস্তুতির বিকল্প নেই। আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও সরকারিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, উদ্ধার করার সময় দেখেছি, বাংলাদেশে ভবনগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ।’
আলী আহমেদ খান আরও বলেন, ‘ভূমিকম্পের ফলে মানুষ মারা যায় না, ভবন ভেঙেই মূলত জান ও মালের ক্ষতি হয়। যখন নিয়ম না মেনে বিল্ডিং তৈরি করা হবে, সেই বিল্ডিং ভেঙেই কিন্তু মানুষ মারা যায়। আর যে বিল্ডিং নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়েছে, সেটি কিন্তু ভেঙে পড়ে না। ফলে মানুষ মারা যায় না এবং ক্ষতিও তেমন একটা হয় না। বাংলাদেশে নিয়ম আছে, কিন্তু কেউ সেই নিয়ম মানে না এবং না মানলে কোনো শাস্তিও তেমনভাবে দেওয়া হয় না। আমরা যখন উদ্ধারকাজে যেতাম, দেখতাম বিল্ডিংগুলো খুবই দুর্বল। এ দুর্বলতার কারণেই বিল্ডিংগুলো ভেঙে পড়ত। কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি না থাকার কারণে দুষ্ট লোকেরা এর সুযোগ নিচ্ছে। আমাদের দেশে বিল্ডিং বা অবকাঠামো বানানোর ক্ষেত্রে অনেক কিছুই এখনো মানা হয় না। কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না।’
এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? মুনির হাসানের প্রশ্নের উত্তরে আলী আহমেদ খান বলেন, ‘আমাদের দেশে ভূমিকম্পের বড় ঝাঁকুনি হলে অবস্থা কী হবে, সেটা ভেবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে একটা সঠিক ও দক্ষ টিম থাকা দরকার। যদিও মালিকেরা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় সবকিছু করছে কিন্তু সরকারের দায়িত্বও পালন করতে হবে। আমাদের বেশির ভাগ স্থাপনা এখন সুরক্ষিত নয়।’
এ বিষয়ে মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, ‘নিয়ম থাকতে হবে এবং সে নিয়ম মানানোর জন্য কর্তৃপক্ষের নজরদারি থাকতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করতে হবে, নিয়ম না মানলে ভবন তৈরি করা যাবে না। এটা মানানোর দায়িত্ব কিন্তু সরকারের এবং রাষ্ট্রের। তাই সব পক্ষকেই সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’