যশোরে কম উচ্চতার ১১ সেতুতে ‘নদী হত্যা’

বিআইডব্লিউটিএ থেকে ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব সেতু নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।

বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র না নিয়ে এমন কম উচ্চতার সেতু বানানো হচ্ছে। এতে বর্ষায় নৌযান চলাচল ব্যাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি যশোরের বাঘারপাড়ার সীমাখালীতে
ছবি: প্রথম আলো

ভৈরব নদের পর এবার যশোরের আরও সাতটি নদীর ওপর কম উচ্চতার ১১টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সেতুগুলো নিচু হওয়ার কারণে বর্ষায় এসব সেতুর নিচ দিয়ে নৌযান চলাচল ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র না নিয়ে সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান সেতুগুলো নির্মাণ করছে।

এর আগে ভৈরব নদের ওপর ৫১টি ‘অপরিকল্পিত’ সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। এ নিয়ে ২০২১ সালের ১৫ জুলাই প্রথম আলোয় ‘নদের টুঁটি চেপে ধরেছে ৫১টি সেতু-কালভার্ট’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

এখন যে সাতটি নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে নিয়ম অনুযায়ী সেগুলোর কোনোটির ক্ষেত্রে সেতুর উচ্চতা হওয়ার কথা পানির স্তর থেকে গার্ডারের নিচ পর্যন্ত ১৬ ফুট, কোনোটির ২৫ ফুট। কিন্তু যে ১১টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে তার সব কটির উচ্চতা ৪ দশমিক ৫৯ ফুট থেকে ১১ দশমিক ৫০ ফুট পর্যন্ত। সেতুগুলোর মধ্যে ১০টি সেতু নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এবং একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (ডব্লিউবিবিআইপি) আওতায়।

নদী প্রবহমান করতে নদী সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিত এসব সেতু নদী প্রবহমান করার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। আমরা অপরিকল্পিত এসব সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করছি এবং এর বিরুদ্ধে আমরা দ্রুত আন্দোলন শুরু করব।
উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ
ভৈরব নদের দুই পাশে মাটি ভরাট করে তার ওপর করা হয়েছে সেতু। এতে নদ হয়ে গেছে সংকুচিত। সম্প্রতি যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা মোড়ে।
প্রথম আলো ফাইল ছবি

অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, নৌপথে খুঁটিসহ বৈদ্যুতিক লাইন ও সেতু নির্মাণ করতে হলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে ছাড়পত্র (নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স) নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব সেতু নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নেয়নি এলজিইডি ও সওজ। বাংলাদেশ নদী কমিশন এবং বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে এসব সেতুর উচ্চতা নিয়ে আপত্তি জানানোর পরও তা আমলে নেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

বিআইডব্লিউটিএ, খুলনার পশ্চিম বদ্বীপ শাখার নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আশ্রাফ উদ্দীন বলেন, নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু যশোরে নদীর ওপর ১১টি সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স নেওয়া হয়নি। সেতুর উচ্চতা কম হওয়ায় নদীতে ছোট ও মাঝারি আকারের নৌযান চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে।

এখন চলছে সংযোগ সেতু নির্মাণের কাজ। হাজরাইল সেতুর নির্মাণ চলমান। উপজেলার নেহালপুর এলাকায় শ্রী নদীর ওপর, মনিরামপুর এবং চিনাটোলা এলাকায় হরিহর নদের ওপর পুরোনো সেতু ভেঙে কম উচ্চতার তিনটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।

এভাবে সেতু নির্মাণ ‘নদী হত্যা’র শামিল মন্তব্য করে ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘নদী প্রবহমান করতে নদী সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিত এসব সেতু নদী প্রবহমান করার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। আমরা অপরিকল্পিত এসব সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করছি এবং এর বিরুদ্ধে আমরা দ্রুত আন্দোলন শুরু করব।’

আরও পড়ুন

বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, ২০১০ সালের আগপর্যন্ত সেতু নির্মাণের জন্য উচ্চতার ছাড়পত্র নেওয়ার কোনো বিধান ছিল না। ২০১০ সালে এ–সংক্রান্ত একটি বিধিমালা হয় এবং তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়। বিধিমালায় নৌপথের শ্রেণি ধরে সেতু নির্মাণের উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য বলা হলেও পথের নাম উল্লেখ করা হয়নি। পরে ২০১৮ সালে গুরুত্বপূর্ণ ৯৫টি নৌপথের নাম উল্লেখ করে আবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

জেলা সমন্বয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে নদ-নদীর ওপর সেতু নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মানদণ্ড মেনে সেতু নির্মাণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
যশোরের জেলা প্রশাসক এবং জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মো. তমিজুল ইসলাম খান

এক প্রশ্নের জবাবে ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ২০১৫ সালে সীমাখালী সেতুর কার্যক্রম শুরু করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে ২০১৮ সালে। যে কারণে সমস্যা হয়েছে।

নির্মাণাধীন ১১টি সেতু এবং সম্প্রতি নির্মাণ করা একটি সেতু কয়েকবার ঘুরে দেখেছেন এই প্রতিবেদক। দেখা গেছে, যশোরের মনিরামপুর উপজেলার টেকারঘাট এলাকায় টেকা নদীর ওপর পুরোনো সেতু ভেঙে সেই জায়গায় নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। পানি থেকে সেতুর উচ্চতা খুব কম। উপজেলার হরিদাসকাটি ইউনিয়নে মুক্তেশ্বরী নদীর দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কম উচ্চতার দুটি নতুন সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে সুবলকাঠি সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে সংযোগ সেতু নির্মাণের কাজ। হাজরাইল সেতুর নির্মাণ চলমান। উপজেলার নেহালপুর এলাকায় শ্রী নদীর ওপর, মনিরামপুর এবং চিনাটোলা এলাকায় হরিহর নদের ওপর পুরোনো সেতু ভেঙে কম উচ্চতার তিনটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

যশোর সদর উপজেলার দাইতলা এবং বাঘারপাড়া উপজেলার ছাতিয়ানতলায় ভৈরব নদের ওপর নির্মিত পুরোনো দুটি সেতু ভেঙে সেই জায়গায় কম উচ্চতার দুটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বাঘারপাড়া উপজেলার সীমাখালীতে চিত্রা নদীর ওপর কম উচ্চতার একটি সেতু নির্মাণ করছে সওজ। সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ। শার্শা উপজেলায় বেতনা নদীর এক কিলোমিটারের দূরত্বের মধ্যে কম উচ্চতার দুটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে কাজীরবেড়-ইসলামপুর মোড়ে এবং অপরটি শেয়ালঘোনা গাতিপাড়া ও নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সংযোগস্থলে। যশোর সদর উপজেলার রূপদিয়ায় ভৈরব নদের ওপর সম্প্রতি নির্মাণ করা সেতুটিরও উচ্চতা কম।

এলজিইডি যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সেতু নির্মাণের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাদের নির্দেশনায় সেতুগুলোর নির্মাণকাজ চলছে। তারা কাজ বন্ধ করতে বললে সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ করা হবে।

জানতে চাইলে যশোরের জেলা প্রশাসক এবং জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মো. তমিজুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, জেলা সমন্বয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে নদ-নদীর ওপর সেতু নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মানদণ্ড মেনে সেতু নির্মাণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।