শখের বশে খামার শুরু করে এখন কোটিপতি

খামারের পুকুরে খাবার ছিটাচ্ছেন খায়রুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

দুই দশক আগে শখের বশে খামার শুরু করেছিলেন খায়রুল ইসলাম (৪৪)। মাছ, মুরগি ও গরু পালন করে এখন তিনি একজন সফল খামারি। খামার করে হয়েছেন কোটিপতি। পেয়েছেন সফল মৎস্যচাষির পুরস্কার।

খায়রুলের বাড়ি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের ঠাণ্ডাছড়ি এলাকায় মোট ৪০ বিঘা জমিতে তাঁর খামার। খামারের পুকুরে তিনি চাষ করেন পাঙাশ, শিং, কই, বাটা ও কার্পজাতীয় মাছ। একই সঙ্গে তিনি খামারে পালন করেন মুরগি ও গরু।

বছরে দেড় কোটি টাকার বেশি মাছ, মুরগি ও গরু বিক্রি করেন খায়রুল। লাভ থাকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। লাভের টাকায় নিজ এলাকায় একটি তিনতলার মার্কেট করেছেন তিনি। কোটি টাকায় চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কসংলগ্ন ১০ শতক জায়গা কিনেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বিনিয়োগ করেছেন। সেখানে মাছ ধরার বড়শির দোকান আছে তাঁর।

২০০০ সালের দিকে ঠাণ্ডাছড়ি এলাকায় চায়ের দোকান দিতেন খায়রুল। সে সময় তিনি শখের বশে নিজের পৈতৃক জমিতে মাছ চাষ ও মুরগি পালন শুরু করেন। এ ছাড়া খামারের জন্য পুকুরসহ কিছু জমি ভাড়া নেন তিনি।

শুরুর দিকে স্থানীয় লোকজন খায়রুলকে কটূক্তি করতেন। তাঁরা বলতেন, ছেলে হয়ে কেন মুরগি পালন করবেন খায়রুল, কেন জেলেদের মতো মাছ চাষ করবেন! তবে এসব কথায় থেমে যাননি তিনি।

আরও পড়ুন

প্রথম বছর খায়রুল ৬৬ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেন। পরে পুকুরের সংখ্যা বাড়ান তিনি। বাড়ান মুরগি ও গরু পালনের পরিসর।

খায়রুলের গরু ঠাণ্ডাছড়ির আশপাশের পাহাড়ে চরানো হয়। তাই গরুর জন্য খুব বেশি বাড়তি খাবার লাগে না। পবিত্র ঈদুল আজহার সময় তাঁর গরু বেশি বিক্রি হয়। গত ঈদুল আজহায় তিনি ৩০ লাখ টাকার গরু বিক্রি করেন।

কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদনে সাফল্যের জন্য ২০১৮ সালে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে চট্টগ্রাম জেলার সফল মৎস্যচাষির পুরস্কার পান খায়রুল। ২০১৪ সালে থানা পর্যায়ের সফল মৎস্যচাষির স্বীকৃতি পান তিনি।

খায়রুলের যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না। একাধিকবার বিপদের মুখে পড়েন তিনি। সবচেয়ে বড় বিপদ আসে ২০০৭ সালের জুন মাসে। পাহাড়ধস ও ঢলে তাঁর ২২ লাখ টাকার মুরগি শেষ হয়ে যায়। ভেসে যায় পুকুরের মাছ। মারা যায় ৫০টির বেশি গরু। তবে তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ান।

খায়রুল ভালো করেই জানেন, নানা বিপদ-আপদ আসবে। কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না। ২০০৭ সালের বিপদের সময় তাঁর পাশে দাঁড়ান স্ত্রী নুরজাহান পপি। তিনি নিজের শখের সোনার গয়না বিক্রি করে টাকা তুলে দেন স্বামীর হাতে। পরিচিতজনদের কাছ থেকে ঋণ নেন খায়রুল। সেই ঋণ পরিশোধ করেন। পরে খামারের পরিসর বাড়াতে তিনি দুটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন।

আরও পড়ুন

সবুজঘেরা পাহাড়ের পাদদেশে খায়রুলের মাছ, মুরগি ও গরুর খামার। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, খামারের পুকুরে খাবার ছিটাচ্ছেন কর্মচারীরা। খাবার খেতে মাছ কিলবিল করছে। পুকুরের পাশে বিভিন্ন শেড। শেডে ছোট-বড় শত শত ব্রয়লার-লেয়ার মুরগি। খামারে গরুর জন্য আছে ছোট ছোট ঘর।

খায়রুলের খামারে ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের বেতন ৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। খামারের ব্যবস্থাপক নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে কাজ করে বেশ কয়েকজন স্বাবলম্বী হয়েছেন। কেউ কেউ পরে নিজেরাই খামার গড়ে তুলেছেন।’

স্থানীয় কলেজশিক্ষক ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, খায়রুল নিজে খামার করার পাশাপাশি বেকার যুবকদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করছেন। তাঁর কাছে এসে পরামর্শ নিয়ে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সরকারিভাবে নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও অনেকে সেখানে যেতে চান না। তাঁরা খায়রুলের কাছে আসতেই পছন্দ করেন।

আরও পড়ুন
২০১৮ সালে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে চট্টগ্রাম জেলার সফল মৎস্যচাষির পুরস্কার পান খায়রুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

১৮ ফেব্রুয়ারি খামারের এক প্রান্তে দেখা যায়, খায়রুল কয়েকজন যুবকের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁরা নানা বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। খায়রুল উত্তর দিচ্ছেন। খায়রুলের কথা শুনে যুবকদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে আশার আলো।

খামারে কথা হয় এক যুবকের সঙ্গে, নাম মো. ইয়ামিন। তিনি রাউজান থেকে এসেছেন। ইয়ামিন জানান, তিনি একসময় বিদেশে ছিলেন। এখন কিছু করেন না। তাঁর কিছু সঞ্চয় আছে। এই অর্থ দিয়ে তিনি বাড়ির পাশের পুকুরে মাছ চাষ করতে চান। আগামী মাসে কাজ শুরু করবেন। তাই খায়রুলের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে এসেছেন।

ইয়ামিন ছাড়াও সেদিন খায়রুলের কাছে পরামর্শ নিতে এসেছিলেন ফটিকছড়ির আবু শাহেদ, হাটহাজারীর মো. কাউসার, নগরের পাহাড়তলীর মো. সামাদ।

আরও পড়ুন

তরুণ-যুবকদের স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে খায়রুলকে একটি উদাহরণ মনে করেন চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে যুবকদের স্বাবলম্বী হতে খাইরুলের মতো উদ্যোগ নিতে হবে। খামার করে তিনি নিজে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। দেশের অর্থনীতিতে তিনি অবদান রাখছেন। পাশাপাশি আমিষের অভাব পূরণেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে খায়রুল প্রথম আলোকে বলেন, আশপাশে পড়ে থাকা জমিগুলোকে কাজে লাগিয়ে খামারের পরিসর আরও বাড়ানোর ইচ্ছা আছে তাঁর। সে ক্ষেত্রে মাছ-মুরগির আমদানি করা খাদ্যের ওপর শুল্ক কমানোর আবেদন করেন তিনি। এ ছাড়া চাকরির পেছনে না ছুটে তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দেন।

আরও পড়ুন